‘বই বাড়ছে, মান বাড়ছে না'
৩০ জানুয়ারি ২০১৮ডয়চে ভেলে: সামনেই বইমেলা৷ আপনাদের প্রস্তুতি কেমন?
মাজহারুল ইসলাম: আমাদের প্রস্তুতি একেবারে শেষ পর্যায়ে৷ এখন তো মেলা অনেক বড় পরিসরে হয়৷ সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে হচ্ছে গত চার বছর ধরে৷ এবার তো স্টলের আকারও বড় হচ্ছে৷ এ সব কারণে পরিসর বড় হচ্ছে, আর আমাদের প্রস্তুতিও খারাপ না, বেশ ভালো৷
ভালো বই প্রকাশে চ্যালেঞ্জ কী?
ভালো বই প্রকাশের সবচেয়ে বড় যে চ্যালেঞ্জ হলো ভালো পাণ্ডুলিপি৷ ভালো পাণ্ডুলিপির একটা সংকট আছে৷ দ্বিতীয় সমস্যা হলো ওই পাণ্ডুলিপিটা সু-সম্পাদিতভাবে প্রকাশ করা৷ আসলে এই বইগুলো সম্পাদনার জন্য যে সম্পাদক প্রয়োজন, সেটা পাওয়া যায় না৷ আবার অধিকাংশ প্রকাশনা সংস্থারই নিজস্ব সম্পাদনা বিভাগ নেই৷ কেন নেই সেটা আবার এক বিরাট আলোচনার বিষয়৷ সে প্রসঙ্গে যাবো না৷ আপাতত ভালো পাণ্ডুলিপি ও সু-সম্পাদিতভাবে প্রকাশ করাই বড় চ্যালেঞ্জ৷
বই বিক্রি তো বাড়ছে, বইয়ের মান কি বাড়ছে?
না, বইয়ের মান সেভাবে বাড়ছে না৷ গতবছর বই মেলায় ৪১০০-র মতো বই বের হয়েছে৷ এর মধ্যে ৫ শতাংশও মানসম্পন্ন বই ছিল সেটা বলা যাবে না৷ আবার সেখানেই যেতে হয় – ভালো পাণ্ডুলিপি ও সু-সম্পাদিতভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে না৷ অনেক লেখক নিজের ইচ্ছাতে পাণ্ডুলিপিটা ভালো করে পড়ে দিচ্ছেন, সেটাই প্রকাশ হচ্ছে৷ এখনো প্রকাশকদের মধ্যে একটা অংশের পেশাদারিত্ব সেভাবে গড়ে উঠেনি৷ এর সঙ্গে আর্থিক বিষয়ও জড়িত৷ এই সেক্টরটা এখনো বেশ অবহেলিত৷
বইমেলা কি লাভজনক হয়?
বইমেলা অবশ্যই লাভজনক৷ আমাদের দেশের লেখক-প্রকাশকরা এই বইমেলার জন্য অপেক্ষা করে থাকেন৷ সারা বছর কোনো বই প্রকাশ হচ্ছে না, বইমেলা ঘিরেই সব বই প্রকাশ হয়৷ এটা এখন আর বইমেলা নয়, এটা বাঙালির চেতনার একটি মেলা, এটা একটা মিলনমেলা৷ এটা আমাদের সংস্কৃতির একটা উৎসব৷ বিশ্বে কিন্তু কোথাও এক মাস ধরে বইমেলা হয় না৷
কোন ধরনের বই বেশি বিক্রি হয়?
সারা বিশ্বেই যেমন সবচেয়ে বেশি চলে উপন্যাস, এখানেও তাই৷ এর বাইরে গল্প, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, ভ্রমন কাহিনি এগুলো চলে৷
আপনি বলছিলেন, প্রকাশকরা বইমেলার অপেক্ষায় থাকেন? কিন্তু বই তো সারা বছর পড়ার বিষয়?
এর পেছনে অনেকগুলো কারণ আছে৷ আমাদের পাঠকরাও এটার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন৷ তাঁরাও বইমেলার জন্য অপেক্ষা করেন৷ এছাড়া মেলার বাইরে বই প্রকাশ হলে পাঠকদের কাছে পরিচিত করা যায় না৷ মেলাতে একটা বই এলে যেভাবে প্রচার হয়, অন্য সময় সেভাবে প্রচার হয় না৷ আর লেখক বা প্রকাশক যদি নিজের উদ্যোগে প্রচার চালাতে চায়, সেটাও কঠিন৷ কারণ পত্রিকার বিজ্ঞাপনের যে ব্যয় সেটা দেয়াও খুব কঠিন৷ সবকিছু মিলিয়েই এটা মেলাকেন্দ্রিক হয়ে গেছে৷
দেশে হুমায়ূন আহমেদ, শামসুর রাহমানের মতো লেখক আসছে না কেন?
দেশে আর হুমায়ূন আহমেদ আসবে না৷ অন্য একজন লেখক আসবেন, তিনি তাঁর মতো করে৷ যেমন আমরা আরেকজন রবীন্দ্রনাথ পাইনি৷ সেটা সম্ভবও না৷ হয়ত ভালো লেখক আসবেন৷ তিনি নিজের মতো করেই জায়গা করে নেবেন৷
আমরা জানি হুমায়ূন আহমেদের অধিকাংশ বই আপনি বের করেছন৷ এবার হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে কোনো নতুন বই আসছে?
হুমায়ুন আহমেদের নতুন বই আসার তো আর কোনো সম্ভাবনা নেই৷ উনাকে ঘিরে প্রতি বছরই কিছু বই বেরুচ্ছে৷ আগামীতেও বের হবে৷ আমরা উনার সংকলন বের করছি৷ উনি বেঁচে থাকতে এটা শুরু হয়েছিল৷ প্রতিবছরই একটা বা দুই খণ্ড রচনাবলী বের হয়৷ এবারও দুই খণ্ড রচনাবলী বের হচ্ছে৷ আর হুমায়ূনকে ঘিরে তো ৩/৪ শ' বই বের হয়েছে৷ এবারও সেই ধারাবাহিকতায় নিশ্চয়ই কিছু বই বাজারে আসবে৷
বইমেলা ও হুমায়ূন আহমেদ ওতপ্রোতভাবে জড়িত৷ বইমেলার সময় কীভাবে তাঁকে স্মরণে রাখা যায়?
এই বইমেলাকে পাঠকপ্রিয় করা, মানুষের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করার পেছনে হুমায়ূন আহমেদের একটা বড় ভূমিকা তো আছেই৷ দুঃখজনক হলো, হুমায়ূন আহমেদ যে বছর না ফেরার দেশে চলে গেলেন, সেবছরও তাঁকে দায়সারাভাবে স্মরণ করা হয়েছে৷ যেভাবে তাঁকে স্মরণ করা উচিত ছিল, সেভাবে স্মরণ করা হয়নি৷ ২০১২ সালে তিনি চলে যান৷ ওই বছর থেকেই লেখক ও প্রকাশকদের পক্ষ থেকে একটা দাবি তোলা হয়েছিল যে, বাংলা একাডেমীর সামনের রাস্তা (দোয়েল চত্ত্বর থেকে টিএসসি পর্যন্ত) তাঁর নামে নামকরণ করা হোক৷ বিশ্বে বহু দেশে নামকরা লেখকদের নামে রাস্তার নাম হয়েছে৷ বাংলাদেশেও হয়েছে৷ অথচ কী কারণে যেন হুমায়ূন আহমেদের নামে এটা হচ্ছে না৷ এটা করা যাঁদের দায়িত্ব, তাঁরাও সেটা করছেন না৷
বইমেলা ঘিরে উগ্রবাদীদের এক ধরনের তৎপরতা আমরা কয়েক বছর ধরে দেখছি, এর কারণ কী?
এটার কারণ বিশ্লেষণ তো আসলে কঠিন৷ তবে এটা বলা যায়, উগ্রবাদীরা সারা বিশ্ব জুড়েই তো তাণ্ডব ছড়ানো, উচ্ছৃঙ্খলতা দেখানো, এ সব করছে৷ তবে গত দুই বছর তেমন কিছু ঘটেনি৷ বিশেষ করে পুলিশের তৎপরতায় গত বছর খুব ভালোভাবে বইমেলা শেষ হয়েছে৷ আর উগ্রবাদীদের এই তৎপরতাও কিন্তু কমে আসছে৷ আমি আশা করছি, এবারের মেলাটাও সুন্দর ও সু-শৃঙ্খলভাবে হবে৷
দেশে ভালো বই, ভালো লেখকের সম্ভাবনা কতটুকু?
অনেকেই লিখছে৷ বিশেষ করে তরুণরা ভালো লিখছে৷ আমরা আশা করছি, সামনের দিনে আমরা ভালো কিছু লেখক পাবো৷
বইমেলায় যে বই আসে, তাতে লেখকদের স্বাধীনতা কতটুকু থাকে?
আমাদের দেশে লেখকরা তো পুরো স্বাধীনতাই ভোগ করেন৷ কোনো বই তো আর সেন্সর করে প্রকাশ হয় না৷ ফলে তাঁরা যেটা লিখছেন, সেটাই প্রকাশ হচ্ছে৷
বই প্রকাশনায় সরকারের সহায়তা কেমন?
এই যে দেখেন চার হাজার বই প্রকাশ হচ্ছে৷ এর মধ্যে হাতে গোনা দু-একজন ছাড়া অধিকাংশ লেখকের বই সেভাবে প্রচার হচ্ছে না৷ ফলে বইগুলো সেভাবে বিক্রি হয় না৷ প্রকাশকরা তাঁদের গোডাউনে ভর্তি করে রাখেন৷ এগুলো আর আলোর মুখ দেখে না৷ এতে প্রকাশকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, বইগুলো পাঠকের কাছে যাচ্ছে না৷ দেখেন, আমাদের পাশেই কলকাতায় একটা বড় বই মেলা হয়৷ সেখানে যে বই প্রকাশ হয়, তার বড় একটা অংশ সরকার কিনে নিয়ে স্কুল, কলেজ এবং পাবলিক পাঠাগারগুলোতে পাঠায়৷ সেখানে সাধারণ মানুষ বইগুলো পড়ার সুযোগ পাচ্ছেন৷ এই সেক্টরে সরকারের একটা প্রণোদনা থাকা উচিত৷ আগে যেটা বলছিলাম, একজন প্রকাশক কেন একজন সম্পাদক রাখতে পারবেন না? কারণ সে নিজেই তো স্বচ্ছল না৷ কারণ, বই বিক্রি করে সারা বছরের খরচের টাকা আসছে না৷ এখন অনেক শিক্ষিত তরুণ এই পেশায় আসছেন এবং ভালো বই তাঁরা বের করছেন৷
গত বছর স্টল ছিল কতটা, আর নতুন বই এসেছিল কত?
গত বছর নতুন বই ছিল ৪ হাজার ১০০৷ আর প্রকাশকদের স্টল ছিল সাড়ে ৩শ'র মতো৷ এর বাইরে মিডিয়া, বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের স্টলও থাকে৷
এবারের বইমেলা ঘিরে আপনার স্বপ্ন কী?
আমরা আশা করছি, এবারের বইমেলা ভালো হবে৷ কারণ এবার দেশের রাজনৈতিক অবস্থা অনেকটাই স্থিতিশীল৷ আমি আশা করছি, অত্যন্ত সফল একটি মেলা এবার হবে৷
এ সাক্ষাৎকারটি প্রসঙ্গে আপনার কিছু বলার থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷