প্রতিবেশী বন্ধুত্ব
২০ মে ২০১২কঠিন সূচনা, সহযোগিতার অঙ্গীকার
নির্বাচনী প্রচারের সময় বার্লিনে এসে ম্যার্কেল'এর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন ফ্রান্সের সমাজতন্ত্রী দলের নেতা ফ্রঁসোয়া ওলঁদ৷ ম্যার্কেল সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন৷ উল্টে তিনি প্রকাশ্যে নিকোলা সার্কোজি'র প্রতি সমর্থন জানান৷ তাতে অবশ্য কোনো ফল হয় নি৷ সার্কোজি'কে হারিয়ে ফ্রান্সের নতুন প্রেসিডেন্ট হয়েছেন ওলঁদ৷ শপথ নেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বার্লিনে গিয়ে ম্যার্কেল'এর সঙ্গে বৈঠক করেছেন তিনি৷ তারপর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছেন৷
অভিনব সম্পর্কের বন্ধন
ওলঁদ সমাজতন্ত্রী নেতা, ম্যার্কেল রক্ষণশীল সিডিইউ দলের৷ কিন্তু অতীতে দলীয় মতাদর্শ কখনো দুই দেশের শীর্ষ নেতার ব্যক্তিগত সম্পর্কের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি৷ ইউরোপের ‘চালিকা শক্তি' বলে পরিচিত এই দুই দেশের সহযোগিতা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, বর্তমান আর্থিক ও অর্থনৈতিক সংকটের সময় তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না৷ সেই শার্ল দ্য গোল ও কনরাড আডেনাউয়ার'এর সময় থেকেই চলে আসছে এই ঐতিহ্য৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ অধ্যায়ের পর দুই দেশের মধ্যে নতুন করে স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে তোলার গুরুদায়িত্ব ছিল তাঁদেরই কাঁধে৷ ১৯৬৩ সালে এলিজে-চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়৷
শার্ল দ্য গোল ও কনরাড আডেনাউয়ার'এর পর বেশ কয়েকজোড়া নেতার মধ্যে তেমন ব্যক্তিগত সখ্য গড়ে ওঠে নি৷ তারপর ১৯৭৪ সালে জার্মান চ্যান্সেলর হেলমুট স্মিট ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ভালেরি জিস্কার দেস্ত্যাঁ'র মধ্যে উষ্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে৷ মতাদর্শগত পার্থক্য সত্ত্বেও দুই নেতা পারস্পরিক সহযোগিতার নতুন এক যুগের পথ দেখিয়েছিলেন, যার ধারাবাহিকতা এখনো পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ রয়েছে৷ হেলমুট কোল ও ফ্রঁসোয়া মিতেরঁ, গেয়ারহার্ড শ্র্যোডার ও জাক শিরাক, আঙ্গেলা ম্যার্কেল ও নিকোলা সার্কোজি – এঁরা ধাপে ধাপে সেই সম্পর্কের বুনিয়াদকে আরও জোরালো করেছেন৷ অভিন্ন মুদ্রা ইউরো থেকে শুরু করে ইউরোপীয় ঐক্যের কোনো সাফল্যই এত সহজে বাস্তব হয়ে উঠতো না, যদি না ফ্রান্স ও জার্মানির নেতারা এই সব কঠিন প্রকল্পের পেছনে নিজেদের পূর্ণ সমর্থন ও ক্ষমতা প্রয়োগ না করতেন৷
ইউরোপের বাকি দেশগুলিও ফরাসি-জার্মান অক্ষশক্তিকে কখনো উপেক্ষা করতে পারে নি৷ ইউরোপীয় সমন্বয় প্রক্রিয়ার স্বার্থে ফ্রান্স ও জার্মানি বার বার তাদের সার্বভৌমত্ব থেকে কিছু অংশ ব্রাসেলস'এর হাতে তুলে দিয়েছে৷
ভবিষ্যতের দায়িত্বভার
সম্পর্কের শুরুটা মধুর না হলেও ইউরোপের স্বার্থে ম্যার্কেল ও ওলঁদ'এর মধ্যে মজবুত সম্পর্ক কি গড়ে উঠতে পারবে? শুরুতেই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ক্ষেত্রে দুই নেতার মতপার্থক্য স্পষ্ট হয়ে গেছে৷ ইউরোপের বর্তমান সংকট কাটাতে ম্যার্কেল কড়া হাতে সরকারি ব্যয় ও বাজেট ঘাটতি নিয়ন্ত্রণের পক্ষে৷ এই প্রশ্নে কোনো আপোশ করতে প্রস্তুত নন তিনি৷
মূলত ম্যার্কেল'এরই উদ্যোগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৫টি দেশ এই মর্মে ‘ফিসক্যাল প্যাক্ট' স্বাক্ষর করেছে৷ ওলঁদ নীতিগতভাবে সেই বোঝাপড়া মেনে নিলেও তার সঙ্গে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে এক সহায়ক কর্মসূচি বা চুক্তির দাবি করে আসছেন৷ ওলঁদ বলেন, ‘‘নির্বাচনী প্রচারের সময় আমি যা বলেছিলাম, আজ সেটা আবার বলছি৷ শুধু বাজেট ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, আমি তা নিয়ে আবার নতুন করে আলোচনা করতে চাই৷'' জবাবে ম্যার্কেল বলেন, ‘‘প্রশ্ন হলো, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সম্পর্কে কার কী চিন্তা রয়েছে৷ এটা একটা সাধারণ সংজ্ঞা৷ প্রবৃদ্ধি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে৷ প্রবৃদ্ধি তরান্বিত করতে যে সব প্রস্তাব রয়েছে, আমরা সেগুলি নিয়ে পরস্পরের সঙ্গে আলোচনা করবো৷ এক্ষেত্রে মতের মিল ও মতপার্থক্য – দুটোই রয়েছে৷ মোটকথা আমি ভবিষ্যৎ সহযোগিতা সম্পর্কে অত্যন্ত আশাবাদী৷''
ইউরো প্রকল্পের বৃহত্তর স্বপ্ন
ম্যার্কেল এপ্রসঙ্গে মনে করিয়ে দেন যে, ইউরোপের কূটনীতি শুধু শিষ্টাচার বা পারস্পরিক আচরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই৷ একাধিক দেশের অভিন্ন মুদ্রা থাকলে যৌথ দায়িত্বও অনেক বেড়ে যায়৷ ইউরো চালু করার পেছনে এটাই ছিল মূল কারণ৷ ইউরোপীয় সমন্বয় প্রক্রিয়ার চাকা যাতে বিপরীত দিকে ঘুরতে না পারে, সেটাই ছিল প্রধান লক্ষ্য৷ ইউরো শুধু একক মুদ্রার প্রকল্প নয়, এটা একটা রাজনৈতিক প্রকল্প৷ ‘‘বাকি বিশ্বের কাছে আমরা এই বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলাম যে ইউরোপে আমরা সঙ্ঘবদ্ধভাবে ভবিষ্যতের দিকে চলতে বদ্ধপরিকর৷ বিশ্বের ৭০০ কোটি জনসংখ্যার অনুপাতে ইউরোপের মাত্র ৫০ কোটি মানুষের জন্য যতটা সম্ভব ঐক্যবদ্ধ থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷''
ম্যার্কেল আরও বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরই অনেকে বলেছিলেন, অনেক দেশ মিলে একক সাধারণ মুদ্রা চালু করলে তাদের মধ্যে যুদ্ধ করা সম্ভবই হবে না৷ আজ ইউরো চালু হওয়ার পর এবং বর্তমান সংকটের পর দেখা যাচ্ছে, যে দেশগুলি পরস্পরের মধ্যে এমনভাবে মতবিনিময় করছে, যেমনটা একটি মন্ত্রিসভার মধ্যে বা স্বরাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে হয়ে থাকে৷ অর্থাৎ মতবিরোধ মানেই সংকট নয়, তা বৃহত্তর গণতান্ত্রিক রীতিরই অঙ্গ৷ যেমন ওলঁদ ও ম্যার্কেল দুই ভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি হওয়া সত্ত্বেও সহযোগিতা সম্ভব৷ জার্মানির মধ্যেও এই ঐতিহ্য চালু আছে৷ দলীয় বিভাজন ছাড়াও ফেডারেল ও রাজ্য সরকারগুলির মধ্যে ঐকমত্যের ভিত্তিতে বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হয়৷ ইউরোপের ক্ষেত্রেও একই প্রক্রিয়া দেখা যায়, বলেন ম্যার্কেল৷
প্রতিবেদন: সঞ্জীব বর্মন
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ