ফুল হইতেও সাবধান!
১ সেপ্টেম্বর ২০২৩নানা সময় কত রকম ফুলের তোড়া যে এসে উপস্থিত হয় অফিসে! কারো জন্মদিনে, বিশেষ কোনো অর্জনে বা প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে হরেক রকম তোড়া আসতে দেখি। কত রকম ফুল! মন মাতানো সব রঙ। চোখ জুড়িয়ে যায়। কিন্তু গন্ধ নিতে গেলে কেমন যেন অস্বস্তি হয়! এক ধরনের ঝাঁঝালো অনুভূতি হয়। মাথা ঘোরার মতো লাগে। অনেক বার এ নিয়ে মনের ভেতর প্রশ্ন এলেও উত্তর জানার খুব একটা চেষ্টা করিনি। চোখ জুড়ালেও, প্রাণ কেন জুড়ায় না এ নিয়ে মাথা খুব একটা ঘামাইনি কখনোই। বরং তোড়া থেকে দুটি ফুল খুলে নিয়ে বাসায় ছোটো বোতলে পানি দিয়ে রেখে দিয়েছি। পরদিন ফুল দুটি কুঁকড়ে শুকিয়ে যেতেও দেখেছি।
তবে চাপা পড়ে থাকা প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলাম হঠাৎ করেই। কদম ফুল বিক্রি হয় কিনা দেখতে গিয়েছিলাম শাহবাগে। তখনই চোখ চলে যায় ভিন্ন এক ঘটনায়। দেখি পদ্ম ফুল ভাঁজ করে করে রাখা হচ্ছে দোকানের কোণায়। জানতে চাইলাম, ‘‘কী হবে এগুলো দিয়ে?'' দোকানের বিক্রেতা জানালেন, ‘‘এগুলো রঙ করা হবে। তোড়া বানানো হবে। কেউ হয়তো এমনিও কিনে নেবেন।'' ‘‘কেমন রঙ? কীভাবে লাগাচ্ছেন? কেন লাগাচ্ছেন?''- এসব প্রশ্নের জবাবে তথ্য যা পেলাম, তা কিছুটা ভয় ধরিয়ে দিয়েছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং কেমিক্যাল বিশেষজ্ঞের মতামত নিতে গিয়ে জানলাম, ভয়ের কারণ আসলেই আছে।
বছরের পর বছর পত্রিকার পাতায় দেখে আসছি নানা রকম খাবারে বিভিন্ন রকমের ভেজাল। গরুর মাংসের কথা বলে বিক্রি হয় মহিষের মাংস। বিরিয়ানিতে দেওয়া হয় টেক্সটাইল কারখানায় কাপড়ে ব্যবহারের রঙ। পরোটা দীর্ঘক্ষণ নরম রাখতে দেওয়া হয় অ্যামোনিয়াম সালফেট ও ইউরিয়া সারের মিশ্রণ। পাউরুটিতে ব্যবহার করা হয় পটাশিয়াম ব্রোমেট। আনারস দ্রুত বড় করতে ও পাকাতে হরমোন স্প্রে, বিষাক্ত রাইপেন-ইথোফেন স্প্রে'র নির্বিচার ব্যবহার। খুঁজতে বসলে এরকম শত শত ভেজালের খবর পাওয়া যাবে। এই ভেজালের রাজ্যে যে ফুলের মতো একটি জিনিসও ঢুকে পড়েছে তা জানলাম এবার।
বিক্রেতারা জানালেন, যশোর-চুয়াডাঙা, ঝিনাইদহ থেকে এসব ফুল আসছে তাদের কাছে। যেসব পদ্ম ফুল আসছে সবই সাদা বা গোলাপি। তবে বিক্রির আগে ফুলের রঙ পাল্টে দেওয়া হচ্ছে। যে যেমন চান, তাকে সেই রঙেই রাঙিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বিদেশ থেকে আসা গ্লাডিওলাস, টিউলিপের মতো ফুলের দাম বেশি; তাই দেশি গোলাপ-গাঁদা-রজনীগন্ধার সঙ্গে রঙ করা পদ্ম মিলিয়ে নজরকাড়া তোড়া তৈরি করে বিক্রি করা হচ্ছে।
ঢাকায় ফুলের প্রধান বাজার শাহবাগের ব্যবসায়ীদের দাবি, মূলত ক্রেতাদের চাহিদা মেটাতেই প্রাকৃতিক ফুলের ওপর কৃত্রিম রঙ ব্যবহার করছেন তারা। ক্রেতারা যে রঙ চান, সে রঙের ফুল সবসময় পাওয়া যায় না, তাই কাজ চালাতে পদ্মফুলের ওপর তারা রাসায়নিক স্প্রে দিয়ে দিচ্ছেন। যে ধরনের রঙ তারা ব্যবহার করছেন, সেগুলো তৈরি হয়েছে কাঠ বা ধাতব বস্তু, দেয়াল বা প্লাস্টিকের ওপর ব্যবহারের জন্য। অথচ জেনে বা না জেনে, অসর্ততা ও অসচেতনতায় এই স্প্রে ব্যবহার করা হচ্ছে ফুলের মতো একটি ‘কোমল' জিনিসে। ফুলের ওপর এই রঙ থেকে শরীরের কোনো ক্ষতি হচ্ছে কিনা বা হবে কিনা সেই ব্যাপারে ভাবছেন না ক্রেতারাও।
ফুলের ওপর ব্যবহার করা হচ্ছে ‘অ্যারোসল পেইন্ট'। বোতলের গায়ে ইংরেজিতে উল্লেখ করা আছে, এটি উচ্চমাত্রার দাহ্য পদার্থ। শিশুদের কাছ থেকে এই রঙ দূরে রাখেতে হবে। রঙ মুখে বা পেটে প্রবেশ করলে দ্রুত বমি করানোর চেষ্টা করতে হবে। চোখে লাগলে দ্রুত প্রচুর পানি ঢেলে ধুয়ে ফেলতে হবে। ত্বকে লেগে ফুলে গেলে বা চুলকানো শুরু হলে দ্রুত ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। বৃষ্টির দিনে আর্দ্রতা বেশি থাকে, স্প্রে ছড়িয়ে যেতে পারে, তাই এরকম আবহাওয়ায় স্প্রে ব্যবহার না করার নির্দেশনাও দেওয়া আছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের অ্যারোসল পেইন্টে রয়েছে রেজিনসহ আরো বেশকিছু বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ। এসব দীর্ঘ দিন ব্যবহার করলে ত্বকের ক্ষতি হতে পারে, ক্ষত বা একজিমা দেখা দিতে পারে। এই রঙ নাকের কাছে নেওয়ার ফলে মাথা ঘোরা, মাথা ব্যথা বা বমি বমি ভাব হতে পারে। যেহেতু উচ্চমাত্রার দাহ্য পদার্থ বলা আছে পেইন্টের বোতলে, তাই গ্লাভস ছাড়া এই রঙয়ের সংস্পর্শে এলে চামড়ায় র্যাশ উঠতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের রঙে সংস্পর্শে থাকলে ক্যানসারেরও ঝুঁকি রয়েছে।
কেমিস্টরা বলছেন, প্রাকৃতিক ফুলের ওপর এরকম স্প্রে ব্যবহার করা ঠিক নয়। ফুলের ওপর স্প্রে করার জন্য আলাদা এক ধরনের রঙ বা ফ্লোরাল স্প্রে পাওয়া যায়। ওই রঙয়ে ইথানল, আইসোপ্রোপানলের (আপিএ) মতো পদার্থ থাকে, যেগুলো মানবদেহের জন্য তেমন ক্ষতিকর নয়। হ্যান্ডওয়াশেও এসব উপাদান থাকে। তবে ওই রঙও ফুলের ওপর স্প্রে করার পর অন্তত তিন থেকে সাত ঘণ্টা শুকাতে হয়। এরপর ওই ফুল ব্যবহার করা যায়। সঙ্গে সঙ্গে তাতে হাত দেওয়া যায় না। কিন্তু বাংলাদেশে ফুলের দোকোনগুলোতে যেসব রঙ ব্যবহার করা হচ্ছে বলে দেখা যাচ্ছে, সেগুলোতে বিষাক্ত উপাদান রয়েছে। কারসেনোজেনিক এলিমেন্ট (ক্যানসার সৃষ্টি করতে পারে এরকম উপাদান) আছে। এরকম রঙ ফুলের ওপর ব্যবহারের প্রতিক্রিয়া হিসেবে ত্বকে চুলকানি, এলার্জি, ফুলে যাওয়ার মতো সমস্যা হতে পারে। শ্বাসের সঙ্গে শরীরের ভেতরে প্রবেশ করলে অ্যাজমা হতে পারে।
প্রশ্ন আসতে পারে, এই বিষ বা ক্ষতির বিষয়ে আমরা সচেতন হবো কীভাবে? দীর্ঘদিনের এই অভ্যাস ঠেকানোই বা যাবে কীভাবে?
আইনের প্রয়োগ থেকেও সচেতনতা আসতে পারে। বিষাক্ত রাসায়নিকে পাকানো ফলের ব্যাপারে সরকার কঠোর হওয়ার পর ক্রেতাদেরও সচেতন হতে দেখা গেছে। কেনা পুরোপুরি বন্ধ না করলেও ফলটা ওষুধ দিয়ে পাকানো কিনা অন্তত এই প্রশ্নটা করছেন অনেকে।
সংবিধানের ১৮ক অনুচ্ছেদে নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন এবং প্রাকৃতিক সম্পদের নিরাপত্তা বিধান করার কথা বলা আছে। সরকার পরিবেশ সংরক্ষণে আইন করেছে। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ (সংশোধন) আইন, ২০১০ অনুযায়ী, ‘দূষণ' বলতে পরিবেশের যে কোনো উপাদানের মধ্যে তরল, গ্যাসীয়, কঠিন, তেজস্ক্রিয় বা অন্য কোনো পদার্থের নির্গমনের মাধ্যমে বায়ু, পানি, মাটি, গবাদিপশু, বন্য প্রাণী, পাখি, মাছ, গাছপালা বা অন্য সব ধরনের জীবনসহ জনস্বাস্থ্যের ক্ষতির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত আছে।
এরকম ক্ষতির জন দুই বছরের কারাদণ্ড বা দুই লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। আবারও একই অপরাধ করলে কমপক্ষে দুই আর সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ড বা অন্তত দুই লাখ টাকা বা সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বলে বিবেচিত সামগ্রী বিক্রি বিক্রির জন্য প্রদর্শন, মজুত, বিতরণ, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিবহন বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করলে এক বছর কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
ফুলের ওপরবিষাক্ত রাসায়নিকের ব্যবহার নিয়ে গণমাধ্যমের প্রচারণা যেমন জরুরি, তেমনি সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তৎপরতাও হয়তো আমাদের বড় ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে পারে।