বইমেলা টইমেলা
৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ময়দান থেকে কলকাতা বইমেলা যবে ইএম বাইপাসের ধারে পাকাপোক্ত মিলনমেলা প্রাঙ্গনে তার ঠিকানা বদলেছে, তবে থেকে মেলার আর আয়তনে বৃদ্ধি পাওয়ার সুযোগ নেই, কিন্তু বইমেলা বাড়ছে বৈচিত্র্যে৷ বইয়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও নানা পশরা জায়গা পাচ্ছে মেলায়, যার সঙ্গে অন্তত পঠন-পাঠনের কোনো সম্পর্ক নেই৷ অথবা আছে, মানে আক্ষরিক অর্থে, কিন্তু যার জন্যে এই বইমেলার আয়োজন, সেই সাহিত্যের বাড়বাড়ন্তের সম্ভাবনা নেই৷ যেমন ধরা যাক, একাধিক বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আজকাল কলকাতা বইমেলায় স্টল দেয়, যার মূল উদ্দেশ্য নতুন শিক্ষার্থীর সন্ধান করা৷ বলা বাহুল্য যে, এ সব শিক্ষা রীতিমত খরচসাপেক্ষ এবং শিক্ষাদানের গোটা প্রক্রিয়াটিই বাণিজ্যিক ভিত্তিতে৷ অর্থাৎ এটি একটি ব্যবসায়িক উদ্যোগ, বইমেলায় যার উপস্থিতির অর্থই হলো সেই ব্যবসা বাড়ানো৷ শিক্ষার প্রসার সেখানে উপলক্ষ্য মাত্র৷
তাও যদি ধরে নেওয়া যায়, উচ্চশিক্ষা পরোক্ষে বই পড়ার অভ্যাসকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে, সোনার গহনা কীভাবে বইমেলায় জায়গা পায়! অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি, এবারের কলকাতা বইমেলায় একটি নামি প্রতিষ্ঠানের গহনার দোকান রয়েছে৷ এর পাশাপাশি রয়েছে আচার-হজমির দোকান, ঘর সাজাবার উপকরণের দোকান এবং অসংখ্য খাবারের দোকান৷ বইমেলা মিলন মেলায় সরে আসার পর প্রথমদিকে খাওয়া-দাওয়া সীমাবদ্ধ ছিল কেবল ফুড কোর্ট চত্বরের মধ্যে৷ কিন্তু এ বছর অগুন্তি খাবারের দোকান গুঁজে দেওয়া হয়েছে বইয়ের দোকানগুলোর মধ্যে৷ এবং সেগুলো যাঁরা চালাচ্ছেন, তাঁদের সম্ভবত কোনো ধারণাই নেই যে এটা আসলে বইয়ের মেলা৷ প্রায় হাত ধরে টেনে তাঁরা সবাইকে দাঁড় করিয়ে দিতে চান খাবারের স্টলের সামনে৷ ঠিক যেভাবে বিভিন্ন বিনোদনমূলক টিভি চ্যানেলের স্টলে প্রায় প্রতিযোগিতা চলছে নিজেদের দিকে বেশি লোক টানার৷ উচ্চগ্রামে লাউডস্পিকার বাজিয়ে তারা নানারকম অনুষ্ঠান করে যাচ্ছে দিনভর, যার সঙ্গে, বলাই বাহুল্য, সাহিত্যের কোনো সম্পর্ক নেই৷
অথচ সাহিত্যের প্রসারে কি যথেষ্ট উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে? মঙ্গলবার কলকাতা বইমেলায় পালিত হলো ‘বাংলাদেশ দিবস'৷ এই উপলক্ষ্যে এক আলোচনাসভায় বাংলাদেশের জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক পরিষদের মাজহারুল ইসলাম৷ তিনি রীতিমত খেদ প্রকাশ করলেন যে প্রতিবেশী দেশ, বাংলাভাষী দেশ, তাও কলকাতা বইমেলায় প্রাপ্য গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না বাংলাদেশকে, তার সাহিত্যকে৷ বাংলাদেশের কবি-লেখকদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচিতি নেই এপারের বাঙালি পাঠকদের৷ তার কোনো উদ্যোগও চোখে পড়ে না কলকাতা বইমেলার উদ্যোক্তাদের তরফে৷ উল্টে বাংলাদেশের বই বেআইনিভাবে প্রকাশ ও বিক্রি করেন কলকাতার কিছু অসাধু প্রকাশক৷ অথচ তা আটকাবার কোনো প্রচেষ্টা নেই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের৷ পশ্চিমবঙ্গ প্রকাশক ও পুস্তক বিক্রেতা সমিতির পক্ষে সভাপতি ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায় অবশ্য দাবি করেন, বই জালিয়াতির একই ঘটনা ঘটে বাংলাদেশেও৷ বরং কলকাতা, তথা পশ্চিমবঙ্গেই বাংলাদেশের বই স্থানীয় প্রকাশকরা আইন মেনে, নিজেদের নামে, নিজেদের আইনি দায়িত্বে প্রকাশ করেন৷ কিন্তু বাংলাদেশে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত নকল করা হয় একেকটি বই৷
এই তর্কের হয়ত একদিন নিষ্পত্তি হবে, কিন্তু সেই তর্কে জেতার থেকেও বড় কথা, বাংলাভাষী দুই অঞ্চলের মধ্যে যে বিশ্বাসহীনতা, তা প্রকট হচ্ছে এই বিতর্কে, যা বাংলা সাহিত্যের পক্ষেই ক্ষতিকর৷ পাশাপাশি বইয়ের থেকেও বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে যে হুজুগ, তাই বা বাঙালির কতটা উপকার করবে! কলকাতা বইমেলা আন্তর্জাতিক ক্যালেন্ডারে নথিভুক্ত হতে পারে, কিন্তু তা আদৌ বাংলা সাহিত্যের উত্তরণে, প্রসারে কোনো সাহায্য করছে কিনা, সে প্রশ্নও থেকেই যাবে!
ঢাকা বইমেলাতেও কি সাহিত্যের বদলে ব্যবসায়িক উদ্যোগ বেশি চোখে পড়ে? জানান আপনার মন্তব্য৷