ফুকুশিমা কি আরেকটি চেরনোবিল?
২৩ মার্চ ২০১১এসব দুর্ঘটনার পরও উন্নত বিশ্ব পরমাণু বিদ্যুতের পথ থেকে সরে আসতে নারাজ৷ কেন?
জাপানের প্রাকৃতিক বিপর্যয় যতটা ক্ষতি করেছে তারচেয়েও অনেক বেশি সর্বনাশ করেছে ফুকুশিমার পরমাণু চুল্লি৷ যে সব দেশে পরমাণু চুল্লি রয়েছে, তারা সবাই এখন চিন্তিত৷ দফায় দফায় তারা বৈঠকে বসছে৷ ইউরোপ নতুন করে ভাবতে বাধ্য হচ্ছে – পরমাণু চুল্লি আদৌ কতটা নিরাপদ? নাকি এই শক্তি বশে আনা কঠিন?
চিন্তিত ইউরোপ
ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে ফ্রান্সে রয়েছে সবচেয়ে বেশি পরমাণু চুল্লি৷ প্রায় ৫৮টি সক্রিয় চুল্লি রয়েছে সেখানে৷ ফ্রান্সের বিদ্যুতের চাহিদার প্রায় তিন চতুর্থাংশই মেটায় পরমাণু শক্তি৷ পরিবেশ মন্ত্রী নাতালি কোসিস্কো মোরিসেট বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই জানান যে, এই পরমাণু চুল্লিগুলো খুবই সাবধানতার সঙ্গে দেখাশোনা করা হয়, কাজ চালানো হয় – কোন ধরণের দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা একেবারেই নেই৷ তাঁর দাবি, রিশটার স্কেলে ৬.৭ মাত্রা পর্যন্ত ভূমিকম্পের পরও পরমাণু চুল্লিগুলো অক্ষত থাকবে৷ উল্লেখ্য, জাপানের সাম্প্রতিক ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৯৷
তবে এসব উত্তরে সন্তুষ্ট নন ইউরোপীয় ইউনিয়নের জ্বালানি বিষয়ক কমিশনার গ্যুন্টার ও্যটিঙার৷ এ মাসের ১৪ তারিখে তিনি জার্মানির এক বেতার কেন্দ্রকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘‘গত তিন দিন আগেও এ ধরণের ঘটনা ঘটতে পারে, এমনটা আমাদের কাছে ছিল অবিশ্বাস্য৷ আর ঠিক এ কারণেই আমাদের কখনোই খুব জোর দিয়ে বলা উচিত নয় যে সব কিছুই নিরাপদ, কোনো সমস্যা নেই এবং হবে না৷ কম্পিউটারের বিভিন্ন ভাইরাস এবং যে কোন মুহূর্তে বিদ্যুৎ শক্তি চলে যাবে – এধরণের পরিস্থিতির জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে৷ আর এধরণের ঘটনার প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে তা জানতে আমাদের আরো বেশি করে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে, আলোচনা করতে হবে৷ পুনর্ব্যবহারযোগ্য জ্বালানীর প্রয়োজনে আমরা বিভিন্ন পরমাণু চুল্লি তৈরি করেছি৷ এসব নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে আমাদের আলোচনায় বসা জরুরি৷''
১৫ তারিখে কমিশনার গ্যুন্টার ও্যটিঙার পর্যবেক্ষণ কমিটি, জ্বালানী এবং বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাতাদের সঙ্গে আলোচনা করতে ব্রাসেলসে আমন্ত্রণ জানান৷ প্রতিটি দেশ তার পরমাণু চু্ল্লির বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের জন্য দায়ী থাকবে৷ তাই এসব চুল্লির নিরাপত্তার দায়-দায়িত্বও প্রতিটি দেশের সরকারের উপরই বর্তায়৷
পরমানু চুল্লি চাই, না থাকলে রক্ষা নাই – আসলেই কি তাই?
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরমাণু দপ্তরটি ‘ইউরাটম' নামে পরিচিত৷ ইউরোপে জ্বালানী শক্তির উৎপাদন অব্যাহত থাকবে – এটা ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার অনেকগুলো মূলনীতির একটি৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নের ১৪টি দেশে প্রায় ১৪৩টি পরমাণু চুল্লি সক্রিয়ভাবে কাজ করছে৷ ছয়টির কাজ শুরু হবে৷ জার্মানি অনেকদিন ধরেই পরমাণু চুল্লি তৈরির পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে চাইছে৷ অন্যদিকে ইতালি এবং পোল্যান্ড তাদের দেশে পরমাণু চুল্লি স্থাপনে আগ্রহ দেখাচ্ছে৷ চেক প্রজাতন্ত্র, স্লোভাকিয়া, বুলগেরিয়া এবং লিথুয়ানিয়ায় নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে৷ বেলজিয়াম এবং সুইডেন তাদের পরমাণু চুল্লির কাজ আরো দীর্ঘায়িত করতে চাইছে৷
অস্ট্রিয়া সবসময়ই পরমানু চুল্লির বিরুদ্ধে – কিন্তু লাভ হয়েছে কি?
ইউরোপের জনসংখ্যা যেভাবে বাড়ছে, সেই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বলতে হবে পরমাণু চুল্লির নিরাপত্তা সত্যিই ভাববার মত বিষয়৷ কমিশনার ও্যটিঙার এই বিষয়টিকে একটি সমস্যা হিসেবেই দেখছেন৷ চিন্তিত ও্যটিঙার বললেন,‘‘আমাদের যে সব দেশে পরমাণু চুল্লি রয়েছে, কোন ধরণের ব্যতিক্রম ছাড়াই আমাদের নিখুঁতভাবে দেখতে হবে, পর্যবেক্ষণ করতে হবে, পরীক্ষা করতে হবে এই পরমাণু চুল্লিগুলো কতটা নিরাপদ৷ যে কোন ধরণের দুর্ঘটনায় তা কতটা ঝুঁকির সম্মুখীন হতে পারে৷ এসব করতে অনেক সময়ের প্রয়োজন হবে, কিন্তু এ ছাড়া অন্য কোন পথ খোলা নেই৷ যে সব দেশে পরমাণু চুল্লি নেই – যেমন অস্ট্রিয়া, তাদের নিরাপত্তা দেখার দায়িত্বও আমাদের কাঁধেই বর্তায়৷ সেই দেশটিও এ নিয়ে চিন্তিত৷ তাই শুধু আমাদের নয়, বরং ইউরোপের বাইরের দেশগুলোর নিরাপত্তাও এর সঙ্গে জড়িত৷''
অস্ট্রিয়ায় কোন পরমাণু চুল্লি নেই এবং দেশটি কখনো তা গড়তে আগ্রহও দেখায়নি৷ তাই যখনই ইউরোপের কোন দেশ পরমাণু চুল্লি বসিয়েছে, তখনই অস্ট্রিয়া ছিল প্রতিবাদে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার৷
ব্রিটিশ জ্বালানী মন্ত্রী ক্রিস হিউন বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ব্রিটেনের পরমাণু চুল্লির দায়িত্বে যারা রয়েছে, তাদের তিনি বার বার অনুরোধ করেছেন খুব গভীর এবং নিঁখুতভাবে জাপানের পুরো পরিস্থিতির দিকে নজর রাখতে৷ কোন ধরণের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে তা সঠিকভাবে নথিপত্র করতে৷ ব্রিটেনে ১৯টি পরমাণু চুল্লি রয়েছে৷ এবং সবগুলোই সক্রিয়৷
প্রতিবেদন: মারিনা জোয়ারদার
সম্পাদনা: সঞ্জীব বর্মন