প্রবাসী আয় ও আন্তব্যাংক লেনদেনে স্বস্তি বিদেশি ঋণ শোধে
২ নভেম্বর ২০২৪গত অর্থবছরে বাংলাদেশের রিজার্ভ পরিস্থিতি ব্যাপক চাপের মুখে পড়ে৷ এক পর্যায়ে তা ২০ বিলিয়ন বা দুই হাজার কোটি ডলারে নেমে আসে৷ রিজার্ভের পতন ঠেকাতে গিয়ে বিভিন্ন সংস্থার ঋণ ও বকেয়া পরিশোধ বন্ধ করে দেয় বিগত সরকার৷ এরমধ্যে বিভিন্ন সংস্থা তাদের বকেয়া পরিশোধের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে চাপ দিতে শুরু করে৷ তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছেন, দায়িত্ব নেয়ার পর গত দুই মাসে প্রায় ২০০ কোটি ডলারের বিদেশি ঋণ ও দেনা শোধের ব্যবস্থা করেছেন তারা৷ আর এটি করা হয়েছে রিজার্ভ থেকে ডলার খরচ না করে৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘রিজার্ভে হাত না দিয়ে আমরা ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধ করেছি৷’’ গভর্নর জানান, পরিশোধকৃত ঋণের বেশিরভাগই বিদ্যুৎ খাতের৷ এছাড়া কৃষিসহ অন্যান্য খাতের দেনাও রয়েছে৷
তবে রিজার্ভে হাত না দিয়ে ঋণ শোধ কীভাবে করা হয়েছে তা পরিষ্কার নয় অধ্যাপক ড. আবুল বারাকাতের কাছে৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘রিজার্ভে হাত না দিয়ে পরিশোধ করার বিষয়টি আমি ভালো বুঝি না দুইটি কারণে৷ কারণ হচ্ছে, আমার কাছে কি রিজার্ভের বাইরে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আছে? ঋণ তো টাকায় পরিশোধ করা হয় না৷ এটা তো ডলারেই পরিশোধ করতে হয়৷ সেই ডলারটা কোথা থেকে আসছে? আপনার রিজার্ভ বেড়ে এমন একটা অবস্থায় গেছে, যদি তাই হয়, তাহলেও তো সেটাও রিজার্ভ। রিজার্ভে হাত না দিয়েঋণ পরিশোধ করলাম- এর অর্থ এই যে, আমি প্রচুর রপ্তানি করলাম বা প্রচুর প্রবাসী আয় এসেছে৷ কিন্তু রিজার্ভের উৎসও তো এগুলোই৷ এটা একটু দুর্বোধ্য মনে হয় আমার কাছে।”
রিজার্ভে হাত না দিয়ে ঋণ পরিশোধ যেভাবে
বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনর ড. আহসান এইচ মনসুরের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, রিজার্ভের উপর কোন চাপ না ফেলেই বিদেশি দেনা পরিশোধ করা হচ্ছে৷ আর তা সম্ভব হয়েছে ‘ইন্টার-ব্যাংক মার্কেট' বা ব্যাংকগুলোর নিজেদের মধ্যে লেনদেনের যে বাজার রয়েছে সেখান থেকে ডলারের সংস্থান করার মাধ্যমে৷ ড. মনসুর বলেন, ‘‘ইন্টার-ব্যাংকে সবাই (ব্যাংকগুলো) সবার ডলার কেনাবেচা করে৷ কারণ সবার কাছে রেমিট্যান্স আসছে প্রতিদিন৷ ব্যাংকগুলো কী করে? ব্যাংকগুলো সেখান থেকে একটা অংশ দিয়ে তাদের এলসি (আমদানির ঋণপত্র) খোলে গ্রাহকদের জন্য৷ বাকি টাকাটা তারা রেখে দেয় অথবা বিক্রি করে বা অন্য ব্যাংকের কাছে বিক্রি করে৷ আমরা যেটা করেছি তাদের বলেছি যাদের উদ্বৃত্ত আছে তারা এখান থেকে নিয়ে ওকে দিয়ে দাও৷ সে এটা শোধ করে দিচ্ছে৷’’
এর পেছনে প্রবাসীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে৷ আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রবাসীরা বৈধপথে বিপুল অর্থ পাঠাচ্ছেন৷ গত জুলাইতে যেখানে প্রবাসী আয় ১৯১ কোটি ডলারে নেমে এসেছিল সেখানে সেপ্টেম্বরে এসেছে ২৪০ কোটি ডলার৷ অন্যদিকে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির পরও রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় আছে৷ গত সেপ্টেম্বরে ৩৮৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে যা জুলাইতে ছিল ৩৮২ কোটি ডলার৷ এর ফলে বাজারে ডলারের প্রবাহ বেড়েছে, যা স্বস্তির জায়গা তৈরি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য৷ এমন প্রেক্ষিতে দায়িত্ব নেয়ার পর আন্তঃব্যাংক লেনদেনের বাজারকে সচল করার উদ্যোগ নেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর৷ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘‘আমাদের ভূমিকা হলো আমরা ইন্টার-ব্যাংক মার্কেটকে সচল করেছি৷ এই মার্কেট বড় মার্কেট৷ এই মার্কেটে বছরে ৮০ বিলিয়ন ডলার লেনদেন হয়৷ কাজেই এই মার্কেটকে অবজ্ঞা করে কেন আমি রিজার্ভ থেকে দিতে যাব৷’’
তারল্য সংকট ও দুর্বল ব্যাংকগুলোর উপর সবল ব্যাংকগুলোর আস্থা না থাকার কারণে বিগত সরকারের সময় বাংলাদেশে আন্তঃব্যাংক লেনদেনে ভাটা পড়েছিল৷ এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকার উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘সোনালী ব্যাংকের কাছে কোনো ডলার নাই৷ অথচ সরকারের সব সংস্থা সোনালী ব্যাংকে গিয়ে এলসি (আমদানির ঋণপত্র) খুলছে৷ সোনালী ব্যাংককে কেউ টাকা দিতে চায় না৷ আমরা তখন ব্যাংকগুলোকে বললাম তোমাদের উদ্বৃত্ত ডলার সোনালী ব্যাংক কিনে নেবে বাজার দরে৷ এতটুকুই আমাদের ভূমিকা৷ ফ্যাসিলিটেটিং (অনুকূল ব্যবস্থা তৈরি) করা৷ ব্যাংক যেন ব্যাংকের সাথে লেনদেন করে৷’’
ব্যাংকগুলোকে সচল রাখা এবং প্রবাসী আয় ও রপ্তানির ধারা বজায় থাকার মাধ্যমে এই বাজার আরো শক্তিশালী হবে বলে মনে করেন গভর্নর৷ এতে সামনের দিনেও রিজার্ভে হাত না দিয়েই বিদেশি ঋণ ও দেনা শোধ করা যাবে বলে আশাবাদী তিনি৷ বলেন, ‘‘আমার তো রেমিট্যান্স আসছে৷ গত বছর এসেছে ২৪ বিলিয়ন ডলার৷ এই বছর এখনকার ধারাবাহিকতায় ৩০ বিলিয়ন ডলার হতে পারে৷ রপ্তানি আছে ৫৫ বিলিয়ন ডলারের মতো৷ সব মিলিয়ে মোট ৮০ বিলিয়ন ডলারের মতো আসে৷ সেখান থেকে আমরা সব দেনা শোধ করে দেব৷ এখান থেকেই আমি দুই বিলিয়ন ডলার ট্রান্সফার করেছি৷’’
বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধির শ্লথ গতি
বিদেশি দেনা শোধে আপাতত স্বস্তির আভাস মিললেও বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে এখনও নানা ধরনের বাধা রয়েছে৷ অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারাকাত বলেন, ‘‘আমরা সাধারণত জানি অর্থনীতির প্রধান তিনটি খাত কৃষি, শিল্প এবং সেবা খাত৷ এর মধ্যে তো বহু শিল্প কারখানা বন্ধ হয়েছে সেটা তো বলাই হচ্ছে, সরকারি তথ্যও সেটা বলছে৷ সেবা খাতের অবস্থাও তো খুব একটা উন্নতি হয়নি৷ জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার তো সেই সাত শতাংশের জায়গায় নেই৷ এখন তিন থেকে সাড়ে চার পর্যন্ত৷ এইটা ঠিক যে, জিডিপি কমে যাচ্ছে। সত্যিকার অর্থেই সেটা থাকার কথাও না৷ বিশেষ করে শিল্প কারখানা বন্ধ হওয়ার কারণে৷ আগের তুলনায় আমদানি ব্যয়বহুল হয়ে গেছে৷ এটার প্রভাব পড়ছে অনেক কিছুর উপর৷ অতীতকালেও যেভাবে বলা হতো বাড়ছে, সবই ভালো এখনও সেই প্রবণতাটা রয়েই গেছে৷ বাস্তব সত্যটা একটু লুকানোর চেষ্টা করা৷ এটা না করলেও হয়৷ এটা করার দরকার প্রয়োজন পড়ে না, দরকার নেই৷”
গত ১০ অক্টোবর প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের সাউথ এশিয়া ডেভেলপমেন্ট আপডেটে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশে চার শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতে পারে৷ ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অর্থনীতি ঠিকমতো না চললে প্রবৃদ্ধির হার আরো কমে তিন দশমিক দুই শতাংশেও নেমে আসতে পারে৷ আর খুব ভালো করলে হবে সর্বোচ্চ পাঁচ দশমিক দুই শতাংশ৷
বিশ্বব্যাংক বলছে, অনিশ্চয়তার কারণে বাংলাদেশে বিনিয়োগ ও শিল্পের প্রবৃদ্ধি দুর্বল হবে৷ সেই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন এলাকার বন্যা কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধিকেও সীমিত করে দেবে৷
বাংলাদেশে শিল্প খাতের সবচেয়ে বড় প্রতিনিধিত্বকারী পোশাক শিল্প৷ এর মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল জানান রাতারাতি বিরাট কোনো পরিবর্তন হবে এমনটা তারাও আশা করেন না৷ ডয়চে ভেলেকে বলেন তিনি বলেন, ‘‘বিগত সরকারের গত দুই তিন বছর আমরা ঠিকমতো এলসি খুলতে যেমন পরিনি, তেমনি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিয়ে আমাদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে৷ এই সব সমস্যার সমাধান যে গত তিন মাসে হয়ে গেছে, এমনটি নয়৷ তবে সরকারের উদ্যোগের মধ্যে আমরা এক ধরনের ইতিবাচক অবস্থা দেখতে পাচ্ছি৷ এই ধারা অব্যহত থাকলে নিশ্চিয় ভালো কিছু হবে৷''
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ মনে করেন ‘গত ১৫ বছরে অর্থনীতি লুণ্ঠিত হয়েছে', যার দায় এর সরকারের ঘাড়ে পড়ছে৷ তিনি বলেন, ‘‘আগের সরকার ১০০ বিলিয়ন বিদেশি ঋণ রেখে গেছে, যে ঋণগুলোতে প্রচুর লুটপাট হয়েছে, পাচার হয়েছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সময় লাগবে। জনগণকে একটু ধৈয্য ধারণ করতে হবে। সাময়িকভাবে প্রবৃদ্ধি কম বলে মনে হলেও এই অবস্থা অব্যহত থাকলে নিশ্চয় পরিস্থিতির উন্নতি হবে৷''
এখনও ঘুরে দাঁড়াতে না পারলেও ব্যাংকিংসহ অর্থনৈতিক বিভিন্ন খাতে যে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে তাকে ইতিবাচক বলে মনে করেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, ‘‘আগের সরকারের জের হিসেবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে একটা চ্যালেঞ্জ আছে৷ কিছু পরিবর্তনের চেষ্টা সরকার করছে৷ কৃষিখাতে একটা পরিবর্তন দরকার৷ উদ্যোগ দরকার৷ দুর্নীতি কমানোর উদ্যোগগুলোও ভালো।”
মূল্যস্ফীতির চাপ
অর্থনীতিতে সাধারণ মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় শঙ্কা জীবন যাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি৷ দীর্ঘদিন ধরেই মুল্যস্ফীতি নয় শতাংশের উপরে রয়েছে৷ বাংলাদেশ ব্যাংক এজন্য সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি বজায় রাখলেও তার প্রতিফলন এখনও বাজারে দেখা যাচ্ছে না৷ অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এখন প্রধান সমস্যা মূল্যস্ফীতি৷ মূল্যস্ফীতি প্রচণ্ডভাবে বেড়ে গিয়েছিল৷ সেটা এখনও কমানো যায়নি৷ আশা করছি, আগামী ডিসেম্বর নাগাদ এটা কমে আসবে৷''
সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি বা বাজারে টাকার প্রবাহ কমানোর অংশ হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর নীতি সুদ হার তিন দফা বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক৷ সবশেষ সুদ হার ১০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে৷ তবে ব্যাংলাদেশ ব্যাংকের এই নীতি কতটা কাজে আসবে তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে৷ ড. গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহ কমলেও সরকারের ঋণ নেওয়ার প্রবণতা না কমলে এই জায়গাটাতে খুব বেশি ফল পাওয়া যাবে না৷ আবার বাজারে পণ্য সরবরাহে ঘাটতি ও কারসাজি বন্ধ না হলেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কঠিন হতে পারে৷
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরও এটিকে সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় বাধা বলে মনে করেন৷ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘‘এই মুহুর্তে আমার কাছে মনে হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনাটা প্রধান চ্যালেঞ্জ৷ এই সরকার আসার পরই বন্যা এবং অতিবৃষ্টি দুটোই হলো৷ সেই কারণে সবজি বাজারে একটা প্রভাব পড়েছে৷ জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে৷ আমরা এটাকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছি৷ আরেকটা বিষয় হলো, মুদ্রাস্ফীতিজনিত মূল্যস্ফীতি সেটাও আমরা নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছি৷ এডিবি বাস্তবায়নে বিশেষ নজর রাখা হচ্ছে। খরচটা কম রাখার চেষ্টা করছি৷’’