পুলিশের ‘ক্রসফায়ার বাণিজ্য’ ঠেকাবে কে?
১৬ আগস্ট ২০২০সাবেক একজন পুলিশ কর্মকর্তা দাবি করেছেন, ‘‘কিছু পুলিশের মাথায় এখন শুধু টাকা, তারা যেকোনো উপায়ে অবৈধ টাকা আয় করতে চায়৷’’
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, ক্রসফায়ারকে পুলিশের কেউ কেউ রীতিমত ‘বাণিজ্যে’ পরিণত করেছেন, টাকা আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন৷
গত ৩১ শে জুলাই টেকনাফের মেরিন ড্রাইভে মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান পুলিশের গুলিতে নিহত হন, যা ‘ক্রসফায়ার' বলে দাবি করা হয়েছিল৷ এই ঘটনার পর টেকনাফে থানার সামনে জড়ো হয়ে আরো অনেক ভুক্তভোগী সাবেক ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন৷ টাকা না দেয়ায় স্বজনদের ক্রসফয়ারের নামে মেরে ফেলা হয়েছে বলে তারা দাবি করেন৷ আবার ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ের অভিযোগও আসছে৷
একইভাবে ঢাকার কোতোয়ালী থানার ওসি মিজানুর রহমানসহ পাঁচ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঢাকার আদালতে মামলা হয়েছে ১৩ আগস্ট৷ মামলার বাদী কেরানীগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা সোহেল মীরের অভিযোগ, গত দুই আগস্ট ঢাকার ওয়াইজ ঘাট থেকে তাকে আটক করা হয়৷ এরপর তার পকেটে থাকা দুই হাজার ৯০০ টাকা নিয়ে নেয় পুলিশ সদস্যরা৷ আরো টাকা দিতে না পারায় তাকে ইয়াবা মামলা দেয়ার কথা বলে কোতয়ালি থানায় নিয়ে যায়৷ থানায় নিয়ে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে পাঁচ লাখ টাকা দাবি করে৷ শেষ পর্যন্ত পুলিশ দেড় লাখ টাকা নিয়ে ক্রসফায়ার থেকে রেহাই দিয়ে কোর্টে চালান করে বলে অভিযোগ তার৷
ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়ের অভিযোগে ১৩ আগস্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া থানা পুলিশের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা হয়েছে৷ হারুন মিয়া নামে একজন ভুক্তভোগীর অভিযোগ ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে তার কাছ থেকে অর্থ আদায় করা হয়৷ এ নিয়ে কথা বললে ওই থানার সেকেন্ড অফিসার নিতাই চন্দ্র দাস তাকে ক্রসফায়ারে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে৷
রাজশাহী রেঞ্জের পুলিশ সুপার দেলোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধেও ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়ের অভিযোগে ১২ আগস্ট ঢাকার আদালতে মামলা করেছেন গোলাম মোস্তফা নামে এক ব্যবসায়ী৷ আদালত অভিযোগটি তদন্তের জন্য পিবিআইকে দায়িত্ব দিয়েছে৷
সিনহা হত্যার পর আইন ও শালিশ কেন্দ্র জানায়, চলতি বছরেই এ পর্যন্ত ১৮৪ জন ‘বন্দুকযুদ্ধের' শিকার হয়েছেন৷ গত বছর এই সংখ্যা ছিলো ৩৬৭ জন৷ ২০১৮ সালে মারা গেছেন ৪২১ জন৷
দুই বছর আগে মাদকবিরোধী অভিযানের সময় ২০১৮ সালর ২৬ মে টেকনাফের ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও সাবেক যুবলীগ নেতা একরামুল হককে হত্যার পরও ক্রসফায়ার নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল৷ একরামের বিরুদ্ধে মাদকের কোনো মামলা বা মাদক ব্যবসার কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি তখন৷ সিনহা হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া পরিস্থিতিতে এই প্রশ্ন উঠছে ক্রসফায়ার কি আদৌ বন্ধ হবে? মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, ‘‘সিনহা হত্যাই প্রথম বা শেষ নয়৷ গত ১৫ বছর ধরে এই ক্রসফায়ার চলছে৷ তিন হাজারের বেশি মানুষ ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন৷ আমাদের দাবি অবিলম্বে ক্রসফায়ার বন্ধ করা হোক৷ আর এ পর্যন্ত যত ক্রসফায়ার হয়েছে সবগুলো তদন্ত করার জন্য একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করে দায়ীদের শাস্তির আওয়তায় আনা হোক৷’’
শুধু ক্রসফায়ার নয়, আরেক আতঙ্কের নাম নিখোঁজ-গুম হয়ে যাওয়া৷ দেড়ুযুগ সময়ে যার শিকার প্রায় সাতশ বলে জানান তিনি৷ নূর খান অভিযোগ করেন, ‘‘প্রথম দিকে পুলিশ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নে ক্রসফায়ারকে সংক্ষিপ্ত পথ হিসেবে বেছে নিলেও এটাকে এখন তাদের অর্থ আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে৷’’
পুলিশের সাবেক এআইজি এবং ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের সাবেক প্রধান সৈয়দ বজলুল করিম মনে করেন, ‘‘কিছু পুলিশ সদস্য বিশেষ করে ওসিরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন৷ পুলিশের একাংশ এখন যেকোনো উপায়ে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনে ব্যস্ত৷ ফলে তারা মাদক ব্যবসায়ও জড়িয়ে পড়ছে৷ আর এই অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে ক্রসফায়ারও ব্যবহার হয়ে থাকতে পারে৷ এই ধরনের ক্রসফায়ার কোনোভাবেই আমি সমর্থন করি না৷’’
তার মতে, ‘‘এজন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দায় নিতে হবে৷ বিশেষ করে পুলিশ সুপারদের দায় সবচেয়ে বেশি৷ কারণ তারাই ওসিদের সুপারভাইজিং অফিসার৷ তাদের অগোচরে পুলিশে এসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটে কিভাবে!’’
এই দুই জনই পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে পুলিশে অতি দ্রুত সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করেন৷
এইসব বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে যোগাযোগ করা হলে আনুষ্ঠানিকভাবে তারা কোন বক্তব্য দিতে রাজি হয়নি৷