1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘পাছে লোকে কিছু বলে' আর কত?

২৮ জানুয়ারি ২০১৯

সমাজ, রাষ্ট্র, মানবজাতি টিকেই আছে শ্রমের ওপর৷ কিন্তু এখনো সেই অতীত কালের ধ্যান-ধারণা নিয়ে ‘ছোট কাজ' ‘বড় কাজের' গ্যাঁড়াকলে আমরা বন্দি৷ দ্রুত এ হীন মানসিকতা দূর করতে না পারলে দেশ এগোলেও, এগোবে না দেশের মানুষ৷

https://p.dw.com/p/3CHjj
প্রতীকী ছবিছবি: Reuters/W. Rattay

জার্মানিতে আসার পর এখানকার শ্রেণিব্যবস্থা বুঝতে গিয়ে খুব বিপদে পড়ে গেলাম৷ বলছি না যে, এখানে অর্থের বৈষম্য নেই৷ কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের যে-কোনো দেশের তুলনায় সামাজিক বৈষম্যটা যতটা সম্ভব কমিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়েছে৷

যার আয় যত বেশি, তাকে তত বেশি ট্যাক্স দিতে হয়৷ ফাঁকি দেয়ার কোনো ব্যবস্থা তো নেইই, বরং তাতে জরিমানাসহ সুদে-আসলে কয়েকগুণ পরিশোধ করার শঙ্কা বাড়ে৷ ফলে হঠাৎ করে কারো আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়াও সম্ভব না৷

ফলে একদিকে ট্রাম বা বাসের মতো গণপরিবহনে যেমন সর্বনিম্ন স্তরের কর্মীরা চড়েন, তাঁর পাশের আসনেই হয়তো কোনো বড় প্রতিষ্ঠানের বড় কর্মকর্তাও বসে আছেন৷

আবার চাইলে কিছু টাকা জমিয়ে সহজ কিস্তিতে গাড়িও কেনা যায়৷ এজন্য খুব বেশি শর্তও আরোপ করা হয় না৷ এমন অনেককে দেখেছি, যাঁদের কাজ নিয়মিত অফিস পরিচ্ছন্ন রাখা, তাঁরাও নিজেদের গাড়ি চালিয়ে কর্মস্থলে আসছেন, যা বাংলাদেশে স্বপ্নের মতো৷ বসই হোন, আর কর্মচারী, কেউ কাউকে দেখে মাথা নিচু করে সরে দাঁড়ায় না, বরং হেসে চোখের দিকে তাকিয়ে অভিভাদন জানায়, শুভেচ্ছা জানায়৷

এত কথা বলার কারণ একটাই, বাংলাদেশে কাজের বৈষম্য এবং তথাকথিত শিক্ষিত মানুষদের মানসিকতা, উন্নসিকতা৷

আমার এক বন্ধু৷ নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স, মাস্টার্স পাশ করে গ্রামে গিয়ে মাছ চাষ করেন৷ আছেন ভালোই৷ স্ত্রী-সন্তান, বাবা-মা নিয়ে সুখের সংসার৷ বিত্তবৈভবেরও কোনো অভাব নেই তাঁর৷ ঢাকার ভেজাল খাবার, বিষাক্ত পরিবেশ থেকে দূরে তিনি খেয়েপড়ে বেশ ভালোই আছেন৷

কিন্তু তবুও তাঁর একটা আক্ষেপ৷ ঢাকা থেকে তাঁর অন্য বন্ধুরা মাঝে মধ্যে গ্রামে বেড়াতে গেলে আড্ডা হয়৷ বন্ধুদের কেউ ম্যাজিস্ট্রেট, কেউ ব্যাংকের ম্যানেজার, কেউ শিক্ষক৷ কিন্তু সে আড্ডায় তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না৷ মাছ চাষ করেন বলেই কিনা কে জানে, তাঁর বন্ধুরা তাঁকে একটু নীচু চোখেই দেখেন৷ অথচ পড়াশোনা, উপার্জন, জীবনমান কোনো দিক দিয়েই বন্ধুদের চেয়ে কম না তিনি৷

অথচ জার্মানিতেই একদিন এক বড় ভাইয়ের সাথে কথা হচ্ছিলো৷ এখানে সব কাজকেই দেখা হয় খুব গুরুত্বের সঙ্গে৷ মনে হলো, আর গিয়ে একটা কাজ শুরু করলেন, এমনটা হবার জো নেই৷ এখানে জুতা সেলাই বা চুল কাটার কাজ করতে হলেও, সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে লাইসেন্স নিতে হয়৷ দরজার তালা খোলার লোক ডাকলেও তাঁকে যে পরিমাণ অর্থ দিতে হয়, সে ভয়েই কেউ চাবি নিয়ে বের হতে ভোলেন না৷ আর গৃহকর্মী রাখতে চাইলে তাঁকে দিতে হয় নিজের চেয়েও বেশি বেতন৷ ফলে, সব কাজ মানে মানে সবাই নিজেরাই করেন৷

কিন্তু বাংলাদেশে কাজের সমতার বিষয়টি এখনো একেবারেই ধরাছোঁয়ার বাইরে৷ একসময় (কিংবা এখনো কেউ কেউ) যেমন ব্রাহ্মণ ও শুদ্রের মধ্যে জন্মগত তফাৎ খুঁজে থাকেন, তেমনি যেন কাজগুলোও ছোট আর বড় তফাৎ করে ফেলা হয়৷ একদিন রাস্তা ঝাড়ু না দিলে, এক সপ্তাহ শহরের ডাস্টবিনগুলো পরিষ্কার না হলে, শ্রমিকরা কাজ বন্ধ করে দিলে, কৃষকরা ফসল ফলানো বন্ধ করে দিলে থেমে যাবে জীবন৷ তখন অফিস-আদালত, কোর্ট-কাচারি, ব্যাংক, কিছুতেই কিছু হবে না৷

HA Asien | Anupam Deb Kanunjna
অনুপম দেব কানুনজ্ঞ, ডয়চে ভেলেছবি: DW/P. Böll

ভেবে দেখুন, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের টাকায় সচল রয়েছে অর্থনীতির চাকা৷ সে প্রবাসীরা কিন্তু ছোট-বড় চিন্তা না করেই কাজ করে চলেছেন নিজেদের একাগ্রতা, শ্রম ও মেধা দিয়ে৷ বিদেশে একজন ডক্টরেট ডিগ্রিধারীর ট্যাক্সি চালাতেও কোনো সমস্যা হয় না৷ দেশে ফিরলে কেন সে কাজেই তাঁর আড়ালে ‘ছিঃ ছিঃ' শুনতে হয়?

কিন্তু ‘কোনো কাজই ছোট না' মুখে স্বীকার করলেও এখনো ‘পাছে লোকে কিছু বলে', তাই উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিন দিন বাড়লেও কেউ নিজের মেধা কাজে লাগিয়ে গ্রামে ফিরে নতুন নতুন উদ্যোগ নেয়ার কথাও ভাবতে পারেন না৷ অথচ, পুরো পৃথিবী জুড়ে এখন নানা ধরনের বিকল্প কর্মসংস্থানের উদ্যোগ এতই বাড়ছে, অনেকে বাসা থেকে বের না হয়েই মাস শেষে নিজের, পরিবারের এবং দেশের উন্নয়নে রাখছেন ভূমিকা৷

হাঁস-মুরগির খামার, কৃষিকাজ, মাছচাষ তো আছেই, কয়েক বছর ধরে ‘অন্যরকম' খামারেও আকৃষ্ট হচ্ছেন তরুণরা৷ দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলেও গড়ে উঠছে কচ্ছপ, উট, উটপাখি, টার্কি, কুমির এমনকি সাপও৷ এরই মধ্যে বিশ্বে নানা ধরনের খামারের যে অপার সম্ভাবনার দ্বার রয়েছে, দেশেও তা খুলতে শুরু করেছে৷

অর্থনীতির যে ক্রমশ অগ্রগতির ধারা গত কয়েক বছর ধরে ধরে রেখেছে বাংলাদেশ, শুধু পোশাক, ওষুধ, চা, পাটের মতো হাতেগোণা কয়েকটি খাতকে কেন্দ্র করে সে ধারা ত্বরান্বিত বা দ্রুত করা প্রায় অসম্ভব৷ ফলে একদিকে সরকারকে যেমন নতুন নতুন খাতকে পৃষ্ঠপোষকতা  দিতে হবে, অন্যদিকে মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিজের ইচ্ছে থাকলে অবশ্যই লোকলজ্জার ভয় এড়িয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে নিজের উন্নয়নে৷

একজন ‘অশিক্ষিত' কৃষক যেসব ঝামেলায় পড়েন ফসল ফলাতে, একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কৃষক অবশ্যই তাঁর চেয়ে কয়েকগুণে ভালো ফলন উপহার দিতে পারেন৷ ফলে নিশ্চিত করতে হবে সবক্ষেত্রে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও৷

লেখকের সাথে আপনি কি একমত? লিখুন নীচের ঘরে৷ 

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য