পশ্চিমবঙ্গে 'দুয়ারে মদ', শুরু তীব্র বিতর্ক
১০ নভেম্বর ২০২২পশ্চিমবঙ্গের সুরাপ্রেমীদের জন্য সুখবর। এ বার হাতের নাগালেই চলে আসছে মদের দোকান। রাজ্য সরকারের সংস্থা ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট বেভারেজ কর্পোরেশন (বেভকো)-র নামে সরাসরি এই ফ্র্যাঞ্চাইজি খোলা হচ্ছে। রাজ্যে বিষাক্ত ও বেআইনি মদের কারবারে লাগাম টানতে এই সিদ্ধান্ত বলে দাবি নবান্নের।
পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় বিষমদে মৃত্যু ঘটনা মাঝেমধ্যে শোনা যায়। সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটেছিল তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পরপরই। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে দক্ষিণ ২৪ পরগনার সংগ্রামপুরে বিষমদ খেয়ে ১৭২ জনের মৃত্যু হয়। এক দশক পরেও বিষমদে পুরোপুরি লাগাম টানা যায়নি।
ফ্র্যাঞ্চাইজি খোলার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে উত্তরবঙ্গকে। তিন জেলার ৯২টি জায়গা চিহ্নিত করা হয়েছে। দার্জিলিংয়ে ৪২, আলিপুরদুয়ারে ৩১ এবং কালিম্পংয়ে ১৯টি ফ্র্যাঞ্চাইজি চালু হচ্ছে ২৯ নভেম্বর। এ জন্য ই-টেন্ডারে আবেদন করতে হবে।
কেন উত্তরবঙ্গকে প্রথমে বেছে নেয়ার সিদ্ধান্ত? রাজ্য সরকারের সূত্র বলছে, এ সব এলাকায় একটি মদের দোকান সঙ্গে অপরটির দূরত্ব বেশি। এই সুযোগে চোরাপথে অন্য রাজ্য থেকে মদ পশ্চিমবঙ্গে আসে। রমরমিয়ে চলে বেআইনি ব্যবসা। নবান্নের লক্ষ্য এতে রাশ টানা।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. সুবর্ণ গোস্বামী এই সিদ্ধান্তকে নেতিবাচক হিসেবেই দেখছেন। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এর ফলে চা-বাগানের স্বল্প আয়ের কর্মীদের নেশার ঝোঁক বাড়তে পারে। মানুষ নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়লে একইসঙ্গে ব্যাধিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কাও বেড়ে যায়। উত্তরবঙ্গে স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল সবই তো দূরে দূরে। মদের দোকান দূরে দূরে, সেটাই দরকার, রাজ্য সরকার এমনটা ভাবল কেন?”
তৃণমূলের বিরোধী থেকে নাগরিকদের একাংশের মতে, সরকার বেআইনি বা বিষমদের কথা বললেও এই উদ্যোগের আসল লক্ষ্য রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানো। রাজ্য আর্থিক সংকটের মধ্যে রয়েছে। বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থের জোগান দিতে হচ্ছে। এর সঙ্গে কর্মচারীদের বেতন, অবসরপ্রাপ্তদের ভাতা দিতেই রাজকোষের অধিকাংশ অর্থ খরচ হয়ে যাচ্ছে।
শারদীয় উৎসবের একটি পরিসংখ্যান বলছে, এমন ভাবনার পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি আছে। এ বার দুর্গাপুজোর চার-পাঁচ দিনে রাজ্যে ৫৫০ কোটি টাকার মদ বিক্রি হয়েছে। দেশি-বিদেশি মদের সঙ্গে বিয়ারের বিপুল চাহিদা ছিল। এর মধ্যে সপ্তমী মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিন হওয়ায় মদের দোকান বন্ধ ছিল। মহাষ্টমীতে বিক্রির অঙ্ক ছিল ১১২ কোটি টাকা। এতে নবান্নের রাজস্ব আদায় বেড়েছে।
এ দিক থেকে রাজ্যের পদক্ষেপকে ইতিবাচকই বলছেন অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকার। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এতে রাজস্ব আদায় বাড়বে তাতে সন্দেহ নেই। একইসঙ্গে চোরাই বা চোলাই মদ খাওয়ার প্রবণতা কমবে। মদের ক্ষেত্রে কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করলে বরং উল্টে বেআইনি মদে ব্যবসা বাড়বে।”
বেআইনি মদ বিক্রি বন্ধ পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন প্রাক্তন আইপিএস ড. নজরুল ইসলাম। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, "রাজনৈতিক নেতা থেকে অফিসাররা সৎ হলে এ সবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হতো। অসৎ বলেই বেআইনি ব্যবসা চলতে থাকে।”
যে বেভকো-র মাধ্যমে মদের দোকান রাজ্য খুলতে চলেছে, তা তৈরি হয়েছিল রাজস্ব ফাঁকি রুখতে। খুচরো বিক্রেতাদের সরাসরি বেভকো-র কাছ থেকে মদ কেনার নিয়ম চালু হয়। উৎপাদকদের কাছ থেকে ডিস্ট্রিবিউটার হয়ে মদ খুচরো বিক্রেতাদের কাছে আসার পদ্ধতি বাতিল হওয়ায় রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি পায়। এ বার বেভকো-র নাম কাজে লাগিয়ে পাড়ায় খুলবে সুরার বিপণি।
মদের নেশার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় নাগরিক ও মহিলা সমাজকে পথে নামতে দেখা গিয়েছে। কখনো রাজনৈতিক দলের পতাকা নিয়ে, কখনো অরাজনৈতিক মঞ্চের ব্যানারে। পর্যবেক্ষকদের মতে, বাঙালি মধ্যবিত্তের মদ্যপানের অভ্যাস বেড়েছে সাম্প্রতিক অতীতে। যদিও দোকান বাড়লেই সুরাপায়ীর সংখ্যা বাড়বে, এই সরল সমীকরণে সকলে সহমত নন।
অনেকেই প্রতিবেশী রাজ্য বিহারের উদাহরণ টানছেন যেখানে মদ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সে রাজ্যের মহিলারা মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের এই পদক্ষেপকে সমর্থন করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ মহিলা কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, "গৃহস্থ মহিলারা এ বিষয়ে খুব স্পর্শকাতর। স্বামী মদ্যপ হয়ে উঠলে পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভেঙে পড়ে, সন্তানের ভবিষ্যৎ বিপন্ন হয়। রাজস্ব বাড়ানোর অন্য পথ খুঁজতে হবে, মানুষকে নেশাগ্রস্ত করার মাধ্যমে আয়ের ভাবনা ঠিক নয়।”