পশ্চিমবঙ্গের চিকিৎসকরা কি ‘ফাঁকিবাজ'?
২৮ এপ্রিল ২০২২ভারতের মানুষ সরকারি চিকিৎসা পরিকাঠামোর উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। পশ্চিমবঙ্গে শহর থেকে জেলার বিভিন্ন পর্যায়ের হাসপাতালে প্রতিদিন রোগীর ভিড় লেগে থাকে। সরকারি হাসপাতালের পরিকাঠামো গত কয়েক বছরে অনেক উন্নত হয়েছে বলে দাবি রাজ্য সরকারের। যদিও কোটি কোটি মানুষকে পরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে নানা অভিযোগ উঠে আসে প্রতিনিয়ত। এর অন্যতম চিকিৎসকদের হাসপাতালে না পাওয়া। এক্ষেত্রে অভিযোগের আঙুল উঠেছে শিক্ষক-চিকিৎসকদের দিকে। অর্থাৎ, যারা রাজ্যের মেডিকেল কলেজগুলিতে শিক্ষাদান করার পাশাপাশি চিকিৎসার পরিষেবা দেন।
দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ উঠছে, শিক্ষক-চিকিৎসকদের একটা বড় অংশ তাদের ভূমিকা যথাযথ পালন করছেন না। যতটা সময় তাদের হাসপাতালে ডিউটিতে থাকার কথা, তারা সেই পরিষেবা দিচ্ছেন না। এদের একাংশ পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে এই ‘ফাঁকিবাজি' চালিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ। এই সমস্যার সমাধানে কঠোর পদক্ষেপ নিতে চলেছে স্বাস্থ্য দপ্তর। অভিযোগ খতিয়ে দেখতে তারা চার সদস্যের একটি কমিটি তৈরি করে দিয়েছিল। এই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে স্বাস্থ্য দফতর নির্দেশিকা তৈরি করছে। তার রূপরেখা কেমন হতে পারে? শিক্ষক-চিকিৎসকদের সপ্তাহে ৪২ ঘন্টা ডিউটি করতেই হবে। অর্থাৎ, একটি ছুটির দিন বাদ দিলে সপ্তাহে গড়ে সাত ঘণ্টা। সকলে রোববার ছুটি পাবেন না, ঘুরিয়ে- ফিরিয়ে রোববার ছুটি নিতে হবে। মেডিকেল কলেজে পড়ানোর পাশাপাশি এই চিকিৎসকদের রোগী দেখতে হবে।
শিক্ষক-চিকিৎসকদের অনেকেই কলেজে পড়ানোর সঙ্গে হাসপাতালে নির্ধারিত ডিউটি করেন। এদের মধ্যে তথাকথিত ‘ফাঁকিবাজ' চিকিৎসকদের সম্পর্কে ক্ষোভ জমা হচ্ছিল। রোগী পরিষেবায় ঘাটতি ও এই চিকিৎসকদের উষ্মায় অবশেষে টনক নড়েছে স্বাস্থ্য ভবনের। যদিও মেডিকেল সার্ভিস সেন্টার-এর পক্ষে ডা. অংশুমান মিত্রের বক্তব্য, "৪২ কেন, ৭০ ঘণ্টাও অনেককে কাজ করতে হয়। অনেক পদ খালি। সহায়ক স্বাস্থ্যকর্মী নেই। ফলে সব কাজ চিকিৎসককে সামলাতে হয়। এই সমস্যা থেকে নজর ঘোরাতে ডাক্তারদের কাঠগড়ায় তোলার চেষ্টা করছে প্রশাসন।”
সার্ভিস ডক্টর্স ফোরাম-এর সাধারণ সম্পাদক ডা. সজল বিশ্বাস বলেন, "৯০ শতাংশ চিকিৎসক ঠিকঠাক ডিউটি করেন। ওভার-ডিউটি করেন, ৩৬৫ দিন ২৪ ঘণ্টা। যে মুষ্টিমেয় চিকিৎসক এটা করেন না, তাঁদের কেন সরকার চিহ্নিত করছে না বা যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছে না?” চিকিৎসকদের অভিযোগ, শাসক ঘনিষ্ঠ ডাক্তাররাই মূলত কম কাজ করেন বা ফাঁকির তালিকায় আছেন। ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টর্স ফোরাম-এর পক্ষে ডাঃ অর্জুন দাশগুপ্ত বলেন, "সরকারি হাসপাতালের ডাক্তাররা যদি সত্যিই ফাঁকি দিত, তাহলে সব পরিকাঠামো হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ত। বরং আয়ুষ্মান ভারত বা স্বাস্থ্যসাথীর মতো বেসরকারি বীমা দিয়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি ঘটাতে চাইছে সরকার। স্বাস্থ্য ব্যাপারটা এত সোজা নয়।”
সরকারি হাসপাতালে ফাঁকিবাজির আরেক রূপ ‘রেফার রোগ'। ‘রেফার' অর্থাৎ একটি হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতলে রোগীকে পাঠানোর সুপারিশ। অনেক ক্ষেত্রেই অভিযোগ উঠেছে, মরণাপন্ন রোগী হাসপাতালে এলে তাকে যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার আগে তড়িঘড়ি অন্য কোনো হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। পরবর্তী হাসপাতাল থেকেও একইভাবে রেফার করে পাঠানো হচ্ছে অন্যত্র। এর ফলে সময় নষ্ট হয়, তাতে অনেক ক্ষেত্রে মৃত্যু হয় রোগীর। মাঝে-মাঝে এই ধরনের ঘটনা সামনে আসে যে, ঘুরে ঘুরে কোনো হাসপাতালে ভর্তি হতে না পেরে রোগীর মৃত্যু হয়েছে।
একটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, রাজ্যের ৯০টি হাসপাতালে ‘রেফার'-এর প্রবণতা বেশি। এর মধ্যে ৩৯টি হাসপাতালকে চিহ্নিত করা হয়েছে যেখান থেকে সাত শতাংশের বেশি রোগীকে রেফার করা হচ্ছে অন্যত্র। এর ভিত্তিতে হাসপাতালের সুপার ও সিএমওএইচ পদাধিকারীদের কড়া চিঠি দিয়েছে স্বাস্থ্য দপ্তর। তাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, প্রাথমিক চিকিৎসা না করে কোনো রোগীকে ‘রেফার' করা যাবে না। রোগীর অবস্থা স্থিতিশীল থাকলে তবেই অন্যত্র পাঠানো যাবে। প্রেসক্রিপশনে লিখতে হবে কোথায় পাঠানো হচ্ছে। সেই হাসপাতালে শয্যা আছে কি না, তা আগে দেখে নিতে হবে।
এই অভিযোগ নতুন উঠেছে এমন নয়। এর সমাধানে ব্যবস্থা নিচ্ছে স্বাস্থ্য দপ্তর। রাজ্য স্বাস্থ্য অধিকর্তা অজয় চক্রবর্তী জানিয়েছেন, বিভিন্ন হাসপাতাল পরিদর্শন করে ‘রেফার রোগ' চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। গত এক দশকে রাজ্যে সরকারি হাসপাতালের সংখ্যা বেড়েছে। তৈরি হয়েছে মেডিকেল কলেজ, সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল। এর ফলে শয্যা সংখ্যা বেড়েছে, বেড়েছে পরিকাঠামোগত সুবিধা। তা সত্ত্বেও ‘রেফার' প্রবণতা কমানো যাচ্ছে না কেন? আদতে পরিকাঠামোই এখনো পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করছেন চিকিৎসকদের একাংশ। ডাঃ অংশুমান মিত্র বলেন, "অনেক হাসপাতালে উপযুক্ত পরিকাঠামো নেই। রক্তপরীক্ষা বা সামান্য ইসিজির দেখে নিতে হবে।
এই অভিযোগ নতুন উঠেছে এমন নয়। এর সমাধানে ব্যবস্থা নিচ্ছে স্বাস্থ্য দপ্তর। রাজ্য স্বাস্থ্য অধিকর্তা অজয় চক্রবর্তী জানিয়েছেন, বিভিন্ন হাসপাতাল পরিদর্শন করে ‘রেফার রোগ' চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। গত এক দশকে রাজ্যে সরকারি হাসপাতালের সংখ্যা বেড়েছে। তৈরি হয়েছে মেডিকেল কলেজ, সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল। এর ফলে শয্যা সংখ্যা বেড়েছে, বেড়েছে পরিকাঠামোগত সুবিধা। তা সত্ত্বেও ‘রেফার' প্রবণতা কমানো যাচ্ছে না কেন? আদতে পরিকাঠামোই এখনো পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করছেন চিকিৎসকদের একাংশ। ডাঃ অংশুমান মিত্র বলেন, "অনেক হাসপাতালে উপযুক্ত পরিকাঠামো নেই। রক্তপরীক্ষা বা সামান্য ইসিজির জন্যও রোগীকে অন্যত্র পাঠাতে হয়।” ডা. অর্জুন দাশগুপ্ত ডয়চে ভেলেকে বলেন, "স্বাস্থ্য খাতে আমরা যা ব্যয় করি তা নগণ্য। সেটা বাড়ালে স্বাস্থ্য পরিষেবাকে সর্বজনীন করে তোলা সম্ভব।” তার বক্তব্য, "জিডিপির মাত্র এক শতাংশ স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় করি আমরা। যেখানে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলিও এর চেয়ে বেশি স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় করে। আমরাই পৃথিবীর একমাত্র দেশ যারা গণটিকাকরণকে বেসরকারি হাতে তুলে দিয়েছি। পরিকাঠামো ঠিক না করে ডাক্তারদের দিকে আঙুল তুলল হবে না।”
চিকিৎসকেরা মনে করছেন, এসব দোষ দেখিয়ে আদতে কর্তৃপক্ষ নিজেদের আড়াল করতে চাইছে। পক্ষান্তরে চিকিৎসকদের জনতার কাছে নিগৃহীত হওয়ার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন৷