নিকারাগুয়ায় কফিচাষের উন্নতিতে অভিনব পদক্ষেপ
১৪ জুন ২০১৮কফি হল মারিয়ার প্রেম৷ প্রায় দু'বছর হল, ২৮ বছর বয়সি মারিয়া হোসে মিদেন্সে নিকারাগুয়ার উত্তরে ওকোটালে তাঁর নিজের ক্যাফেটেরিয়া চালাচ্ছেন৷ এস্প্রেসো হোক আর কাপুচিনো, মারিয়ার কফি এই মফস্বল শহরে একটা বিশেষত্ব বৈকি – কেননা এ ছাড়া এখানে আর কোনো ক্যাফেটেরিয়া নেই৷ মারিয়া শোনালেন: ‘‘আমি কিছুদিন মানাগুয়ায় ছিলাম৷ ওখানকার ক্যাফেটেরিয়াগুলোকে দেখেছি – দেখে আমার খুব ভালো লেগেছে৷ আমাদের গ্রামে তখন নানা ধরনের কফি চেখে দেখার কোনো সুযোগ ছিল না৷''
মারিয়া রাজধানীতে তাঁর কাজ ছেড়ে দিয়ে গ্রামে ফিরে নিজের ক্যাফেটেরিয়াটি খোলেন৷ কফি সম্পর্কে তাঁর আগ্রহ তখন থেকেই৷ আজ তিনি এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রশিক্ষণার্থী – কিন্তু কেন?
মারিয়া বললেন, ‘‘কৌতূহলের বসেই আমি এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে আসি৷ আমার নতুন কিছু শেখার ইচ্ছে ছিল৷ পাঠ্যক্রম চলাকালীন আমি কফির প্রেমে পড়ে যাই, ভাবতে শুরু করি, আমার নিজের ক্যাফেটেরিয়া খুললে কেমন হয়৷''
প্রশিক্ষণ কেন্দ্র
গনসালো কাস্তিও মোরেনো ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে কফির চাষ করছেন৷ তাঁর এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের উদ্দেশ্য হল, বিশ্ববাজারে কফির দাম পড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে কফিচাষিদের আধুনিক ও টেকসই খামার পরিচালনার শিক্ষা দেওয়া, যাতে তারা নিজেদের রোজগার বাড়াতে পারেন৷ কাস্তিওর ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই কফিচাষি পরিবারের সন্তান৷
কাস্তিও জানালেন, ‘‘আমাদের ‘ইস্কুলের' লক্ষ্য হল, কফিচাষিদের শেখানো, তারা কীভাবে নিজেদের কফিখেতগুলোকে আরো সুন্দর করতে পারেন আর খেতের ফসল বাড়াতে পারেন৷ যাতে তারা নিজের জমিটুকুকে ভালোবাসতে শেখেন ও তাদের চাকরির সন্ধানে শহরে যেতে না হয়৷''
দেড় বছরের প্রশিক্ষণে পড়ুয়ারা কফি চাষ থেকে শুরু করে ফসল তোলা ও কফি বিন উৎপাদন পর্যন্ত সব কিছু শেখেন৷ কফি বিনগুলোকে মেশিনে গুঁড়া করার কাজটাও শেখেন তারা – উৎপাদনের আর কোনো পর্যায়ে এই পরিমাণ পানির দরকার হয় না৷
হুয়ান ফ্রান্সিস্কো মার্তিনেস প্রশিক্ষণার্থীদের এই সব প্রসঙ্গ সম্পর্কে সচেতন করে তোলার চেষ্টা করেন৷ তিনি নিকারাগুয়ায় ইউটিজেড কর্মসূচির প্রতিনিধি৷ সংস্থাটি এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রকে আর্থিক সাহায্য দিয়ে থাকে এবং সামাজিক ও পরিবেশগত শর্তাবলী অনুযায়ী কফি ও অন্যান্য কৃষিপণ্যকে সার্টিফিকেট দিয়ে থাকে৷ এর ফলে কফিচাষিরা তাদের কফি কিছুটা বেশি দামে বিক্রি করতে পারেন৷
জলবায়ু পরিবর্তন
কফিচাষিদের সামনে অন্যান্য নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে৷ হুয়ানের ভাষ্যে: ‘‘জলবায়ু পরিবর্তন একটি বাস্তব৷ প্রতিদিন আমরা তাপমাত্রা বাড়ার কথা উপলব্ধি করতে পারি৷ যখন শুকনো থাকার কথা, তখন বৃষ্টি হয়৷ বৃষ্টি পড়বে কি না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই – কফিচাষের উপর যার প্রভাব পড়ে৷ এ বছর নিকারাগুয়ায় ২০ থেকে ৩০ শতাংশ কম কফি উৎপাদন হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে৷''
কফিচাষি গনসালো কাস্তিওর খামারেও তা অনুভব করা যায়৷ এবারের শীতে যে কফি তোলার মজুররা মৌসুম শেষ হবার দু'সপ্তাহ আগেই শেষ কফি ফলগুলোকে ভাঁড়ারে তুলে ফেলেছেন, তার কারণ হল ৷ ব্যাপক বৃষ্টি আর উচ্চ তাপমাত্রার কারণে কফি গাছগুলোতে ঠিক সময়ের অনেক আগেই ফুল ধরে৷ এর পরেও ফসল তোলার অর্থ আগামী মৌসুমে ফসল কম হবার আশঙ্কা৷
কাজেই এ বছর ফসল কম হবে বলে কাস্তিও ধরে নিয়েছেন৷ কেন? তিনি তো বলেছেন যে, তাঁর এযাবৎ কোনো লোকসান হয়নি? শুধু ফসল কম হয়েছে বলেই যে আর্থিক লোকসান হবে, এমন কোনো কথা নেই৷ তবে একটি বিষয় মনে রাখতে হয়৷ কাস্তিওর ভাষায়, ‘‘প্রায় সব চাষিরই লোকসান হয়েছে, শুধু আমার নয়, অন্তত এ পর্যন্ত নয় – ঈশ্বরের কৃপায় আর আমার কফির উৎকর্ষের দরুণ৷''
পরিবেশ ও কফি শ্রমিক
পাকা কফি ফলের রং লাল৷ তা থেকেই কফির স্বাদ ভালো হয় ও পরে ভালো দাম পাওয়া যায়৷ সেজন্য কাস্তিও তাঁর মজদুরদের ভালো মজুরি দিয়ে থাকেন, এক বালতি কফি কুলের জন্য আনুমানিক এক ইউরো ত্রিশ সেন্ট – যা কিনা আশপাশের খামারগুলোর চেয়ে ৪০ শতাংশ বেশি, জানালেন একজন শ্রমিক৷ সহায় সম্বলহীন মহিলারাও কাস্তিওর কাছে কাজ পেয়ে থাকেন৷
সার্টিফিকেট পাবার জন্য কফিচাষিদের পরিবেশ সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হয়৷ যে পানি দিয়ে কাঁচা কফি পরিষ্কার করা হয়, তা গিয়ে পড়ে একটি চৌবাচ্চায় – আগে এই ময়লা পানি নদীতে গিয়ে পড়ত৷ কাস্তিও ফেলে দেওয়া কফি ফল জমিয়ে তা থেকে অরগ্যানিক সার করেন৷
তাঁর কফি খামারে চিরকাল এরকম সুব্যবস্থা ছিল না৷ কাস্তিও দু'বছর আগে টেকসই উৎপাদনের স্বীকৃতি পেয়েছেন৷ তার জন্য তাঁকে অনেক কিছু বদলাতে হয়েছে৷ কাস্তিও বললেন,
‘‘আজ লোকে জানে, এই কফি আসে কোথা থেকে: এমন একটি খামার থেকে, যেখানে ভালো মজুরি দেওয়া হয়, যেখানে কোনো শিশুশ্রম নেই, যেখানে আমরা পরিবেশকে রক্ষা করি৷ তার ফলে আমি আমার কফির জন্য কিছুটা বেশি দাম পাই৷''
সার্টিফিকেট
ইউটিজেড-এর ছাপ থাকলে বাজারে সাধারণ কফির জন্য পাঁচ থেকে দশ শতাংশ বেশি দাম পাওয়া যায়৷ তবে কফির মান খুব ভালো হলে খদ্দেররা কয়েক গুণ বেশি দাম দিয়ে কফি কিনতেও দ্বিধা করেন না৷ তার জন্য সার্টিফিকেটের প্রয়োজন; ইউটিজেডের ছাপ ছাড়া কফিচাষিরা তাদের কফির জন্য এতো ভলো দাম পেতেন না৷
সেটা যে পরিবেশের পক্ষেও ভালো, তা কাস্তিওর খামারের প্রান্তে এসে বোঝা যায়৷ এখানে যে ছোট নদীটি বয়ে যাচ্ছে, তার জল আগে চারপাশের কফির খামারের ময়লা পড়ে কালো হয়ে থাকত, শোনালেন কাস্তিও৷ সে জলে নাকি কোনো মাছ বাঁচতে পারত না৷
আজ পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা, কেননা নিকারাগুয়ায় কাস্তিওর মতো কফিচাষিরা টেকসই কফি উৎপাদনের উপর জোর দিচ্ছেন৷
অলিভার রিস্টাউ/এসি