নরমপন্থিদের হটিয়ে মন্ত্রিসভায় কট্টরপন্থিরা কেন?
১০ জুন ২০১৯২০২৪ সালের নির্বাচনে হিন্দুরাষ্ট্রের ধ্বজা নিয়ে সামনের সারিতে হাজির হতে পারেন যোগী আদিত্যনাথ৷
শুরুটা হয়েছিল বছর পাঁচেক আগে ভারতীয় জনতা পার্টির ‘ওল্ড গার্ড' লালকৃষ্ণ আদবানি, মুরলীমনোহর যোশী, শান্তা কুমার, অরুণ শৌরিদের সরকার থেকে সরিয়ে দলের ‘মার্গ দর্শন মণ্ডলি'তে পাঠানো দিয়ে৷ তারপর ধারাবাহিকতার পদক্ষেপ হিসেবে সামনে এল জাতীয়তাবাদের মুখোশ৷ মুখটা উগ্র দিন্দুত্বের৷ নরেন্দ্র মোদীকে সামনে রেখে এবার হিন্দুরাষ্ট্র গড়ার পথে আরও এক ধাপ এগোল আরএসএস৷ সরলেন সুষমা স্বরাজ, অরুণ জেটলি, উমা ভারতীরা৷ না সরানো হলেও ক্ষমতা খর্ব করা হল রাজনাথ সিংয়ের৷ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক থেকে তাঁকে পাঠানো হয়েছে প্রতিরক্ষায়৷ প্রকৃতপক্ষে মোদীর উত্তরসূরি হিসেবে সংঘ তুলে ধরতে চাইছে উত্তরপ্রদেশের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথকে৷ এই স্বপ্ন নিয়েই এগোচ্ছে সংঘ৷ গোপন এই ইচ্ছের ছাপ বেশ স্পষ্ট এবারের মন্ত্রিসভায়৷
এবার মন্ত্রিসভায় প্রাধান্য পেলেন কারা? স্বাধীন ভারতে সবচেয়ে কলঙ্কিত অধ্যায় ২০০২ সালের গুজরাটের জাতি দাঙ্গা৷ হিন্দু ও মুসলিম মিলিয়ে সরকারি হিসেবে এক হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে সেই দাঙ্গায়৷ মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায় এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই নরেন্দ্র মোদীর। উঠে এলেন অমিত শাহ৷ যিনি মোদীর ছায়াসঙ্গী হিসেবে পরিচিত৷ যিনি গুজরাট এনকাউন্টার মামলায় অভিযুক্ত ছিলেন৷ যাঁর ছেলে জয় শাহের ব্যবসা রাতারাতি ফুলেফেঁপে ওঠা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিরোধীরা৷ গুজরাটে মোদী মুখ্যমন্ত্রী থাকা কালে তিনি ছিলেন সেখানকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী৷ একাধিক অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে৷ এলেন প্রতাপ ষড়ঙ্গী৷ তাঁকে বলা হয়, ‘ওডিশার মোদী' যিনি সাধারণ জীবনযাপন করেন৷ অথচ, ১৯৯৯ সালে অস্ট্রেলীয় মিশনারি গ্রাহাম স্টেইন ও তাঁর ১১ ও সাত বছর বয়সী দুই ছেলেকে পুড়িয়ে মারার ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্ত তিনি৷ গ্রাহামের ‘অপরাধ' ছিল তিনি খ্রীষ্টান৷ বিহার থেকে মন্ত্রিসভায় জায়গা পাকা করে নিয়েছেন গিরিরাজ সিং৷ যিনি ইফতারে অংশ নেওয়ায় দলের নেতাদের প্রকাশ্যে সমালোচনা করেন৷ যিনি কথায় কথায় বিজেপি-বিরোধীদের পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়ার কথা বলেন৷ স্বাধ্বী প্রজ্ঞা৷ যিনি মালেগাঁও বোমা বিস্ফোরণের অন্যতম অভিযুক্ত৷ যাঁর দাবি, গো-মূত্রে ক্যানসার সেরেছে৷ এবার সঞ্জীব কুমার বলিয়ানের প্রমোশন হয়েছে। এই দাপুটে এন জাঠ নেতা ভারতের এক কলঙ্কিত অধ্যায় ২০১৩ এর উত্তরপ্রদেশের মুজফফরপুর জাতি দাঙ্গায় অন্যতম অভিযুক্ত৷
কেউ বলতে পারেন, আদবানি, যোশী, উমা ভারতীরা বাবরি মসজিদ ধ্বংসে অভিযুক্ত ছিলেন৷ কিন্তু, বিজেপির ওই নেতারা মনে করেন, রাম মন্দির গড়ার আন্দোলনে নাম জড়ানোয় তাঁরা গর্বিত৷
সব দেখেশুনে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশের মত, আরএসএসের অ্যাজেন্ডা অনুযায়ী ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্রের দিকে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া গতি পেয়েছে৷ মুখে সংখ্যালঘুদের সঙ্গে নিয়ে চলার কথা বললেও মন্ত্রিসভায় পুরোনো মুখ মুক্তার আব্বাস নাকভি ছাড়া আর কেউ নেই৷ থাকবেই বা কী করে? সংখ্যালঘু সাংসদ কই! মন্ত্রিসভায় দলিত মুখই বা কই?
অমিত শাহ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের দায়িত্ব নিয়েই নজর দিয়েছেন রামমন্দির তৈরি করা এবং জম্মু কাশ্মীরে সংবিধানের ৩৭০ ও ৩৫-এ অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করায়৷ হিন্দুত্বের ধ্বজাধারী, দাঙ্গায় অভিযুক্ত এবং মানুষ খুনে অভিযুক্তরা এখন সরকারের মাথায় চড়ে বসলেন৷ সাধারণের বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, মোদী সরকার কোন দিকে এগোতে চাইছে৷
এবার মোদী মন্ত্রিসভায় দুইজন নরমপন্থি নেতা অরুণ জেটলি ও সুষমা স্বরাজ৷ এই দুইজন ছিলেন৷ বিরোধী-সহ অন্য সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে তাঁদের৷ দুজনই শারীরিক অসুস্থতার কথা জানিয়েছেন৷ কিন্তু, অতীত ঘেঁটে দেখলে বোঝা যাবে অসুস্থ শরীর নিয়ে যদি কোনও একটিমাত্র কাজ করা সম্ভব হয়, তবে তা মন্ত্রীত্ব সামলানো৷ সুষমা এমন এক ভারতীয় নেত্রী যাঁর জনপ্রিয়তা দলমতের গণ্ডি ছাড়িয়ে বহুদূর বিস্তৃত। দেশ-বিদেশে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে রয়েছে। এবার মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েছেন জগৎপ্রকাশ নাড্ডা, সুরেশ প্রভু, রাধামোহন সিং, রাজ্যবর্ধন রাঠোর, জয়ন্ত সিনহা, মহেশ শর্মা এবং অনুপ্রিয়া প্যাটেল৷ পশ্চিমবঙ্গে গত নির্বাচনে মাত্র দুটি আসন পেয়েছিল বিজেপি৷ এবার তাদের ঝুলিতে ১৮টি৷ কিন্তু, বাংলা থেকে জয়ী সাংসদদের মধে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তেমন কেউ নেই৷ তাই মোদী মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পাননি কেউই৷ রাষ্ট্রমন্ত্রী করা হয়েছে বাবুল সুপ্রিয় ও দেবশ্রী চৌধুরিকে৷ এবার কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী করা হয়েছে রমেশ পোখরিয়াল নিশাঙ্ককে৷ যাঁর নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে৷
উত্তরপ্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী এবং লখনউ থেকে জয়ী (অটলবিহারীর পর ভারতীয় রাজনীতিতে কৌলিন্য হিসেবে ধরা হত) হয়ে আসা রাজনাথ সিংয়ের ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে৷ তিনিও সংঘের মতাদর্শের মানুষ হলেও নরমপন্থি নেতা হিসেবে পরিচিত৷ বিরোধী শিবিরের তুখোড় নেতা-নেত্রীদের শান্ত করতে রাজনাথের জুড়ি মেলা ভার৷ দিল্লির রাজনীতিতে পোড় খাওয়া মানুষ৷ বাজপেয়ীর শিষ্য৷ অমিত শাহকে তুলে আনার জন্য রাজনাথকে সরিয়ে দিয়েছেন মোদী৷ ইঙ্গিত স্পষ্ট৷ ভবিষ্যতে রাজনাথের পরিণতি আদবানির মতো হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই৷ এই সিদ্ধান্তের পেছনে মোদীর উত্তরসূরি নির্বাচনের গোপন এক প্রক্রিয়া দেখা যায় বৈকি৷ তবে, কেউ কেউ যেমন বলছেন, মোদির পর অমিত শাহ নন, আদিত্যনাথ৷ গোরক্ষপুর মন্দিরের হত্তাকত্তা৷ রামকৃষ্ণ মিশনের সমান্তরাল সংগঠন চালানোর ক্ষমতাধারী হিন্দুত্বের ধ্বজাধারী এই যোগীকেই ভবিষ্যতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে ভারতীয় জনতা পার্টির মাতৃ সংগঠনের অন্দরে৷ বাহ্যিক ভাবে তেমন প্রয়াস অবশ্য চোখে পড়ে না৷ এই প্রসঙ্গে অতীতে সংঘের নেতা গোবিন্দাচার্যের এক উক্তি মনে পড়ে গেল৷ তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমাদের মুখ অটলবিহারী বাজপেয়ী৷ মুখোশ লালকৃষ্ণ আদবানী৷''