ধূমপান রোধে নতুন কৌশল
১৪ জানুয়ারি ২০১৩জার্মান ক্যানসার গবেষণা কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী প্রতিবছর প্রায় এক লক্ষ দশ হাজার মানুষ তামাক সেবন বা ধূমপানের কারণে মৃত্যু বরণ করছে৷ রোগাক্রান্ত হচ্ছে অনেকে৷ তাই ধূমপান রোধে এখন নতুন করে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে৷
‘‘প্রতিদিন যদি ৩০০ যাত্রী নিয়ে একটি করে জাম্বো জেট ধ্বংস হয়, তাহলে মানুষ আর প্লেনে উঠতে চাইবে না৷'' বলেন, জার্মান ক্যানসার গবেষণা কেন্দ্রের মুখপাত্র মার্টিনা লাঙার৷
অথচ ধূমপায়ীদের ক্ষেত্রে কিন্তু বিষয়টি তেমন নয়৷ ধূমপায়ীরা জানেন, ফুসফুস ও গলার ক্যানসারসহ নানা ধরনের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা তাঁদের অধূমপায়ীদের চেয়ে অনেক বেশি, তবু সিগারেটের আকর্ষণকে পাশ কাটাতে পারেন না অনেকেই৷
জার্মানির এক চতুর্থাংশ প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ নিয়মিত সিগারেটের দিকে হাত বাড়ান৷ অন্যান্য দেশে যেমন, কোরিয়া, রাশিয়া বা বাংলাদেশে ধূমপায়ীর হার আরো অনেক বেশি৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে জনসাধারণের অর্ধেকেরও বেশি ধূমপানে আসক্ত৷
জার্মানিতে ধূমপান নিয়ে বহু বছর ধরে বিতর্ক চলে আসছে৷ বার, রেস্তঁরা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে ধূমপান নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে বহু উত্তেজক আলোচনা হয়েছে৷ কিন্তু এ ব্যাপারে জার্মানির সবগুলি অঙ্গরাজ্য ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারেনি৷ সম্প্রতি ইউরোপীয় কমিশনের স্বাস্থ্য ও ভোক্তাসুরক্ষা বিভাগের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে একটি নীতিমালা উপস্থাপন করা হয়েছে৷
সিগারেটের প্যাকেটে ভয়াবহ ছবি
এই নীতিমালায় বিশেষ নতুনত্ব হলো: ভবিষ্যতে সিগারেটের প্যাকেটে আঁতকে ওঠার মতো ছবি থাকবে, যা ধূমপানের ভয়াবহ ক্ষতিকর দিকটা তুলে ধরবে৷ ধূমপানের কারণে যে সব রোগ সচরাচর দেখা যায়, সেগুলি হলো, ফুসফুসের ক্যানসার, ফুসফুসের নানাবিধ রোগব্যাধি, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ইত্যাদি৷ এই জাতীয় রোগে আক্রান্ত মানুষদের ফটো লাগানো থাকবে সিগারের প্যাকেটে৷ অস্ট্রেলিয়া, ক্যানাডা ও ব্রাজিলে এই ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক৷ ‘ধূমপান মুখ গহ্বরের ক্যানসারের কারণ' – এই কথাটি সিগারেটের প্যাকেটের ওপর লেখা থাকে সে সব দেশে৷ সেই সাথে যুক্ত করা হয় ঐ ক্যানসারে আক্রান্ত এক ব্যক্তির ছবি৷ যা দেখে ক্রেতারা আঁতকে ওঠেন৷ জার্মানিতে এখন পর্যন্ত সিগারেটের প্যাকেটের ওপর শুধু মাত্র সতর্কীকরণ বাণীই দেখা যায়, যেমন সিগারেটের প্যাকেটে লেখা থাকে ‘সিগারেট মৃত্যু ঘটায়'!
সমালোচনার সুর
তবে এই ধরনের উদ্যোগের বিরুদ্ধে সমালোচনা শোনা যাচ্ছে জার্মান সিগারেট সংঘের পক্ষ থেকে৷ এই সংঘের মুখপাত্র ডিয়র্ক পানগ্রিটস ডয়চে ভেলের সঙ্গে এক সাক্ষাত্কারে বলেন, ‘‘ভবিষ্যতে সিগারেটের প্যাকেটের ৭৫ শতাংশ সতর্কতাসূচক বাণী ও ফটোর জন্য সংরক্ষিত থাকবে৷ সিগারেটের নিজস্ব মার্কার জন্য তেমন কোনো জায়গাই আর থাকবে না৷ এই ধরনের পরিকল্পনা মেনে নেওয়া যায় না৷'' তামাক কোম্পানি রেমটসমা এই নীতিমালার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবে বলে জানিয়েছে৷ অবশ্য জার্মান সিগারেট সংঘ, যেটি অনেকগুলি তামাক কোম্পানির সমন্বয়ে গঠিত, ক্রেতাদের স্বাস্থ্য রক্ষার বিষয়টিকে অবহেলা করে না৷ ১৮ বছরের কম বয়সের তরুণরা যাতে সিগারেট কিনতে না পারে, সে ব্যাপারে সাহায্য করে থাকে সংঘটি৷
ফলাফল ইতিবাচকহতে পারে
বাস্তবিকই নানা প্রচারণার ফলে তরুণদের মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা কমে গিয়েছে৷ এই গ্রুপটিকেই কাছে টানতে চায় তামাক শিল্পকারখানাগুলি৷ অস্ট্রেলিয়া ও ক্যানাডার এক সমীক্ষায় জানা গেছে যে, প্রতি দশ জনে নয় জন তরুণই সিগারেটের প্যাকেটে সুস্পষ্ট সতর্কতামূলক দিক নির্দেশনা আশা করেন৷ জার্মানিতেও অধিকাংশেরই একই মত৷
ক্যানসার গবেষক মার্টিনা লাঙার জানান, ‘‘ভয়ংকর ছবিগুলি কাজ লাগছে৷ আমাদের সমীক্ষা থেকে জানতে পেরেছি, ফটোযুক্ত সতর্কবাণী ধূমপান রোধের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তোলে৷''
ধূমপানের কুফল সম্পর্কে ভোক্তাদের নিশ্ছিদ্রভাবে সবরকম তথ্য দেওয়া হয়েছে, সিগারেট লবির এই যুক্তি খণ্ডন করে মার্টিনা বলেন, ‘‘বিশেষকরে শিক্ষা বঞ্চিত মানুষদের মধ্যে এই বার্তা ঠিক মতো পৌঁছাচ্ছে না৷ আর যাঁরা অনেক বছর ধরে ধূমপানে অভ্যস্ত, তাঁদের কাছে সতর্কতামূলক উক্তির তেমন কোনো আবেদন আর নেই৷''
এই গবেষকের মতে, এ জন্য কৌশলটা মাঝে মাঝে পরিবর্তন করা দরকার৷ ছবিসহ সতর্কতা বাণী ব্যয়বহুল নয় এবং কার্যকরী এক মাধ্যম, যা প্রতিটি ধূমপায়ীর কাছে সরাসরি পৌঁছে যেতে পারে৷
একটি সিগারেটেই মারাত্মক ক্ষতি
অন্যদিকে, সিগারেট সংঘের প্রতিনিধি পানগ্রিটস মনে করেন, শুধু তামাকই স্বাস্থ্যহানিকর একমাত্র বস্তু নয়, বেশি চিনি বা মিষ্টি জাতীয় খাবার খাওয়াও স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর৷ তাই মিষ্টি উত্পাদনকারীদের ক্ষেত্রেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত৷ কেননা তারা তো একই নৌকার সহযাত্রী৷
মার্টিনা লাঙার-এর মতে, ‘‘এই দুইয়ের মধ্যে তুলনা চলে না৷ তামাকের রয়েছে বিশেষ ক্ষতিকর প্রভাব৷ ধূমপায়ীদের অর্ধেকেই মারা যায় তামাক সেবনের কারণে দেখা দেওয়া নানা রকম অসুখ বিসুখে৷'' চিনি কেবল অতিরিক্ত মাত্রায় খেলেই স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়৷ কিন্তু একটি মাত্র সিগারেটই রয়েছে ‘অপরিমেয় বিষের' বোঝা, যা শরীরে ক্ষতিকর পরিবর্তন ঘটাতে পারে৷