1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ধর্ম নিয়ে মন্তব্য : দণ্ডিত শিক্ষকের পরিবার এখনো ঘরছাড়া

সমীর কুমার দে ঢাকা
৬ জুলাই ২০২২

ফেসবুকে ধর্ম নিয়ে মন্তব্য করে ৮ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত স্কুলশিক্ষক দেবব্রত দাশ দেবুর পরিবার এখনো এলাকায় ফেরেনি। ছোট্ট দু’টি সন্তানকে নিয়ে তার স্ত্রী আত্মীয়ের বাড়িতে অবস্থান করছেন।

https://p.dw.com/p/4Dl07
Symbolbild Laptop Cyberattacke
প্রতীকী ছবিছবি: Dominic Lipinski/PA Wire/picture alliance

ভয়-আতঙ্কে ঠিকমত কথাও বলতে পারছেন না। স্বামীর এমন সাজায় বিস্মিত-হতবাক এই নারী। স্বামী কারাগারে এখন কী করবেন ভাবতেও পারছেন না।

ফেসবুকে ইসলাম নিয়ে মন্তব্য করে ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’ দেওয়ার অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলায় শিক্ষক দেবব্রতকে আট বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন চট্টগ্রামের বিভাগীয় সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মদ জহিরুল কবীর। গত সোমবার পাঁচ বছর আগের করা এ মামলার রায়ে আদালত কারাদণ্ডের পাশাপাশি ২০ হাজার টাকা জরিমানাও করেছেন। ওই টাকা দিতে না পারলে তাকে আরও ছয় মাসের কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে।

দণ্ডপ্রাপ্ত দেবব্রত দাশ নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলার চৌমুহনি উচ্চ বিদ্যালয়ের হিন্দু ধর্মের সহকারী শিক্ষক ছিলেন। হাতিয়া উপজেলার দক্ষিণ চরইশ্বর ইউনিয়নের সুবল চন্দ্র দাশের ছেলে। তার স্ত্রী আঁখি রানী দাশও দক্ষিন গামছাখালী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক।

মামলার বিবরণে জানা যায়, ২০১৭ সালের ১৫ ও ২৮ অক্টোবর ফেসবুকে ইসলাম ধর্ম নিয়ে মন্তব্য করেন দেবব্রত দাশ দেবু। এরপর তার বিরুদ্ধে ‘ধর্ম অবমাননার’ অভিযোগ তুলে ৩১ অক্টোবর তার স্কুলের সামনে কিছু লোক মানববন্ধন করে। ওইদিনই পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করে। ২০১৮ সালের ১০ জুন ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক এই মামলার অভিযোগ গঠন করেন এবং পরে মামলাটি বিচারের জন্য চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাইবার ট্রাইব্যুনালে  পাঠানো হয়।

আঁখি রানী দাশ

দেবব্রতর সাজা হওয়ার পর আর বাড়িতে যাননি আঁখি রানী দাশ। ১০ বছরের ছেলে আর ৬ বছরের মেয়েকে নিয়ে আত্মীয়ের বাড়িতেই আছেন। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, “স্বামীর সাজা হওয়ার পর এখন খুবই মানসিক বিপর্যয়ে আছি। মামলা হওয়ার পর দেবব্রতকে যখন পুলিশ গ্রেফতার করে তখন আমাদের বাড়িতে হামলা হয়েছিল। অনেক কিছু ভাঙচুর করেছিল, নিয়েও গিয়েছিল। রায়ের আগের দিন আত্মীয়ের বাড়িতে এসেছি। জামিনে ছাড়া পাওয়ার পর দেবব্রত আমাকে বলেছিল, এই পোস্ট তিনি দেননি।” তাহলে আদালতে কেন ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন? জবাবে তিনি বলেন, “পুলিশের মারধরের ভয়ে তিনি এমন স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন।”  

সাইবার ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে কি উচ্চ আদালতে আপিল করার প্রস্তুতি নিয়েছেন? জানতে চাইলে আঁখি রানী দাশ বলেন, “আমার স্বামীর পক্ষে কোন আইনজীবী দাঁড়িয়েছিলেন সেটা আমি জানি না। এখনও কোন আইনজীবীর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হয়নি।” মামলার বিষয়টি দেবব্রত নিজেই দেখভাল করছিলেন। আঁখির বাবা ভবেশ চন্দ্র দাশ ডয়চে ভেলেকে বলেন, “আমাদের তো আইনজীবী ধরে উচ্চ আদালতে যাওয়ার সামর্থ্য নেই। তাই এখনও এসব নিয়ে ভাবিনি।”

এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ছিলেন মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, “শিক্ষক দেবব্রত দাশ দেবু রায় ঘোষণার সময় আদালতে হাজির ছিলেন। সাজা ঘোষণার পর তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। তিনি দোষ স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছিলেন। তিনি যখন কারাগারে ছিলেন তখন জেল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে চাইলে জবানবন্দি প্রত্যাহারের আবেদন করতে পারতেন। আইনজীবীর মাধ্যমেও সেটা করতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেটা করেননি। আদালতে ছয়জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। তারা যেটা দেখেছেন আদালতে সেটাই বলেছেন। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার কারণে আদালত তাকে শাস্তি দিয়েছেন। অভিযুক্ত সবার পরিবারই মনে করেন তিনি অপরাধ করেননি। এখন তারা এই রায়ে সন্তুষ্ট না হলে উচ্চ আদালতে যেতে পারেন। এর বিকল্প তো তাদের হাতে নেই।”

আদালতে দেবব্রত দাশের পক্ষে আইনজীবী কে ছিলেন, সেটা তার পরিবার জানে না। এমনকি রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীও তার নাম বলতে পারেননি। পরে আদালতে নথি পর্যালোচনা করে পেশকারের মাধ্যমে জানা গেল দেবব্রতর আইনজীবী ছিলেন মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন। ডয়চে ভেলের পক্ষ থেকে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, দেবব্রতর গ্রামের এক ভাইয়ের মাধ্যমে তার পক্ষে আইনি লড়াই করেছেন। আদালতে আমরা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছি তিনি নির্দোষ। যেহেতু আদালত থেকে তার সাজা হয়েছে তাই এখন উচ্চ আদালতে আবেদনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। দেবব্রতর পরিবার এটা জানে কিনা? জবাবে তিনি বলেন, “তার ওই দুঃসম্পর্কের ভাইয়ের মাধ্যমে পরিবারকে জানানো হবে।”

মেসবাহ উদ্দিন চৌধুরী

আইনজীবীর দুর্বলতার কারণে কি অনেক সময় আদালতে বিনা দোষে কেউ দোষী হতে পারেন? জানতে চাইলে সিনিয়র আইনজীবী শাহদীন মালিক ডয়চে ভেলেকে বলেন, “অবশ্যই হতে পারে। আর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন তো নতুন। অনেক আইনজীবী এটা ঠিকমতো নাও বুঝতে পারেন। এখন যেটা হয়েছে, প্রচুর আইনজীবী। আইন বিষয়ে শুধু লেখাপড়া করলেই ভালো আইনজীবী হওয়া যাবে না। কাজের ক্ষেত্রে আমি দেখেছি, পড়াশোনা ২০ ভাগ ক্ষেত্রে কাজে লাগে। আর ৮০ ভাগ লাগে সিনিয়রের কাছ থেকে শেখা। এখন এত বেশি জুনিয়র আসছে তারা সিনিয়রের কাছ থেকে শিখতে পারছে না। আর তাদের শেখানোর জন্য এত বেশি সিনিয়রও নেই। মামলাও বাড়ছে, ফলে জুনিয়ররা আদালতে এসেই মামলা পেয়ে যাচ্ছে। ফলে তারা সব ক্ষেত্রে সঠিকভাবে মক্কেলকে আইনি সুরক্ষা দিতে পারছেন এটা বলা যাবে না।”

হিন্দু বৌদ্ধ খিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত ডয়চে ভেলেকে বলেন, “এখন যে পরিস্থিতি তাতে আঁখি বাড়ি ফিরতে ভয় পাবেন এটাই স্বাভাবিক। তবে তাকে বাড়িতে ফিরতে হবে। প্রয়োজনে আমরা প্রশাসনকে বলে দেবো। সারাদেশেই এখন সংখ্যালঘুরা এক ধরনের আতঙ্কের মধ্যে আছেন। নানা অজুহাতে তাদের উপর নির্যাতন করা হচ্ছে। গ্রেফতার করা হচ্ছে। এটা নিয়ে আমরা বারবার বলে আসছি, কিন্তু সরকার আমাদের কথা শুনছে না।”

সম্প্রতি আরও দু’টি ধর্ম অবমাননার মামলার সাজার কথা জানা গেছে। গত ২৪ এপ্রিল অন্যের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে ধর্ম অবমাননার দায়ে বাপন দাস (২৭) নামে এক যুবককে আট বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। বরিশাল বিভাগীয় সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. গোলাম ফারুক এ রায় দেন। এ মামলায় একমাত্র আসামী ছিলেন বাপন দাস।

জানা গেছে, ২০১৯ সালের ২৫ অক্টোবর বিকেলে ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার বাসিন্দা বিপ্লব চন্দ্র বৈদ্য (২৫) নামে এক তরুণের নিজের ছবি সংবলিত ফেসবুক আইডি থেকে মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে মন্তব্য করে কয়েকজন ফেসবুক বন্ধুর কাছে মেসেজ পাঠান। এতে এলাকায় বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এরপর ওইদিন সন্ধ্যার পর বিপ্লব বৈদ্য বোরহানউদ্দিন থানায় তার আইডি হ্যাক হয়েছে- এই মর্মে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে আসেন। এ সময় পুলিশ বিষয়টি তদন্ত ও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে আটক করে। জিজ্ঞাসাবাদের সূত্র ধরে পটুয়াখালীর মো. ইমন (১৮) ও কামরুল ইসলাম শরিফ (১৮) নামে দুই তরুণকে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার করা হয়। এ ঘটনায় ২৭ অক্টোবর পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিতে চারজন মারা যায়। এরপর ফেসবুকে কটূক্তির ঘটনায় বিপ্লব বৈদ্য, মো. ইমন ও কামরুলের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করে পুলিশ। পরে ২০২০ সালের ১৭ জানুয়ারি মামলাটির তদন্তভার পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কাছে হন্তান্তর করা হয়। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে এবং জব্দকৃত মোবাইল ফোন ও অন্যান্য ডিভাইসের ফরেনসিক প্রতিবেদন অনুযায়ী বেরিয়ে আসে এই মামলায় গ্রেফতার বিপ্লব বৈদ্য, মো. ইমন (১৮) ও কামরুল ইসলাম শরিফের (১৮) বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সত্য নয়। মূলত বিপ্লব বৈদ্যের ফেসবুক আইডি হ্যাক করে যে ফোন থেকে এই অপপ্রচার চালানো হয়েছিল সেই ফোনটি কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার চাচুয়া গ্রামের বিকাশ দাসের ছেলে বাপন দাসের (২৫)। এরপর বাপন দাসকে গ্রেফতার করে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে বাপন দাস স্বীকার করেন বিষয়টি।

এছাড়া গত বছরের পহেলা নভেম্বর পাবনার আতাইকুলায় এক যুবকের আইডি ব্যবহার করে ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার পোস্ট দেয়ায় তিনজনকে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। একই সঙ্গে তাদের এক লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়। ২০১৩ সালের ২ নভেম্বর আতাইকুলা উপজেলায় রাজীব নামের এক হিন্দু ধর্মাবলম্বী যুবকের ফেসবুক আইডি থেকে ধর্ম অবমাননাকর ছবি পোস্ট দেয়া হয়। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী রাজীবের বাড়িতে ও স্থানীয় বাজারে হামলা, ভাঙচুরের পর আগুন লাগিয়ে দেয়। এ ঘটনায় মামলার পর বেড়িয়ে আসে আমিনুল এহসান আতাইকুলার স্থানীয় বাজারে নিজের ফটোকপির দোকান থেকে একটা ছবিটি বিক্রি করেন অপর আসামি খোকনের কাছে। পরে খোকন একই বাজারের আরেক দোকানদার আসামি জহিরুলের কম্পিউটারের দোকান থেকে রাজীবের ফেসবুক আইডি ব্যবহার করে ওই ছবি আপলোড করেছে।

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য