1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ঢাকার ৭০ ভাগ মাঠ দখল

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
২৯ এপ্রিল ২০২২

ঢাকা শহরের খেলার মাঠ বা পার্কের তালিকাটা কাজীর গরুর মতো, যা কেতাবে আছে বাস্তবে নেই৷ আর যা আছে তার সর্বোচ্চ ১৮ ভাগে সাধারণের প্রবেশাধিকার আছে৷ বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের এক গবেষণায় এই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে৷

https://p.dw.com/p/4AbMO
পুরান ঢাকার ধূপখোলা মাঠের একপাশে পাঁচতলা ভবন নির্মাণ করছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনছবি: DW

ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের ১২৯টি ওয়ার্ডে খেলার মাঠ আছে ২৩৫টি৷ সিটি কর্পোরেশনের মালিকানার বাইরে আরো কিছু মাঠ আছে৷ এটা হিসাবের কথা৷ কিন্তু সেই মাঠগুলোর বাস্তব অবস্থা কী?

সিটি কর্পোরেশনের এই মাঠগুলোর মাত্র ৪২টি মাঠ সাধারণ মানুষ ব্যবহার করতে পারে৷ বাকি মাঠগুলো নানাভাবে দখল হয়ে আছে৷ শতকরা হিসেবে মাত্র ১৮ ভাগ মাঠ সাধারণ মানুষ ব্যবহার করতে পারেন৷ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দখলে আছে ৬০ ভাগ৷ আর সরাসরি সরকারের দখলে আছে সাত ভাগ৷ তবে সিটি কর্পোরেশনের মালিকানার বাইরের মাঠগুলো ধরলে সর্বোচ্চ ৩০ ভাগ মাঠ এখনো দখলমুক্ত আছে বলে জানান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক, নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মোহাম্মদ খান৷ কিন্তু সেই মাঠগুলোর সবগুলোতে সাধারণ মানুষ যেতে পারেন না৷

মাঠ দখলের করুণ গল্প

দখল করা মাঠে নানা স্থাপনা, ক্লাব, মার্কেট এমনকি হাটবাজার পর্যন্ত গড়ে উঠেছে৷ পুরান ঢাকায় সিটি কর্পোরেশনের ধূপখোলা মাঠটি এখন বন্ধ৷ সেখানে মার্কেট করছে সিটি কর্পোরেশন নিজেই৷ তবে খোলা কিছু জায়গা রাখা হয়েছে মাঠের নামে৷ কিন্তু মার্কেট উঠে গেলে মাঠের বাকি অংশের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে৷

শ্যামলী ক্লাব মাঠটিতে বসানো হয়েছে কাঁচাবাজার, ইরাকি খেলার মাঠেও কাঁচাবাজার বসানো হয়েছে৷ মিরপুরে হারুন মোল্লা ঈদগাহ আগে ছিল খেলার মাঠ, এখন সেটা দখল করে পাইকারি পণ্যের আড়ৎ হিসেবে ভাড়া দেয়া হয়েছে৷ লালমাটিয়া বি ব্লকের নিউ কলোনি মাঠে অস্থায়ী দোকান বসানো হয়েছে৷ যেটুকু ফাঁকা জায়গা আছে তা শুক্রবারে আবার গাড়ি বাজার হিসেবে ব্যবহার করা হয়৷

ক্লাবের নামে মাঠ দখলের নতুন কৌশল শুরু হয়েছে: মোবাশ্বের হোসেন

জেনেভা ক্যাম্প এবং করাইল বস্তির কাছে নবীন সংঘ খেলার মাঠ এবং টি অ্যান্ড টি খেলার মাঠ উভয়ই মাদকাসক্ত ও মাদকদ্রব্য বিক্রেতাদের দখলে৷ শহীদ পার্ক খেলার মাঠে আসবাবপত্র বিক্রি হয়৷ রায়েরবাজার বৈশাখি খেলার মাঠ ঢাকা পড়েছে ময়লা আবর্জনায়৷

ঢাকার উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ২৬ নং ওয়ার্ড খেলাঘর মাঠ সরকার জমি অধিগ্রহণ করছে ৷ বনানী খেলার মাঠ এবং বনানীর চেয়ারম্যান বাড়ি মাঠকে বাঁশের কাঠামো দিয়ে দোকান ও পার্টি কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়৷ এরকম আরো অনেক মাঠ দখল এবং মাঠের করুণ মৃত্যুর গল্প আছে ঢাকা শহরে৷ কোথাও কোথাও মেলার নামে ব্যবসা কেন্দ্রও করা হয়েছে৷

নতুন কৌশল

স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, মাঠ দখল করে সরাসরি মার্কেট বা স্থাপনা নির্মাণ ছাড়াও ক্লাবের নামে মাঠ দখলের নতুন কৌশল শুরু হয়েছে৷ মাঠ ঠিকই আছে, কিন্তু সেটা কোনো ক্লাবের নাম দিয়ে প্রকারান্তরে দখল করা হয়েছে৷ সাধারণ মানুষ আর সেই মাঠে যেতে পারেন না৷ তিনি উদাহরণ হিসেবে ধানমন্ডি মাঠকে শেখ জামাল ক্লাব মাঠে রূপান্তরের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘‘এই মাঠটিতে এখন আর সাধারণ মানুষ প্রবেশ করতে পারে না৷ আমি উচ্চ আদালতে রিট করে পক্ষে রায় পেয়েও সেটা বন্ধ করতে পারিনি৷ আদালত অবমাননার অভিযোগ নিয়ে গিয়েছিলাম, বিচারকেরা বিব্রত হয়েছেন৷’’

তিনি জানান, এই সময়ের আলোচিত তেঁতুলতলা মাঠকে ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানে মাঠ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে৷ বলা হয়েছে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার একমাত্র মাঠ৷ ১৯৮০ সালে এখানে সরকার শিশু পার্ক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল৷ কিন্তু এখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন এটা মাঠ নয়, পতিত জমি ছিল৷ সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা যদি একের পর এক মাঠ নিয়ে এরকম কাজ করেন, তাহলে মাঠ রক্ষা পাবে কীভাবে?
তার কথা, ‘‘যখন উচ্চ পর্যায় থেকে এই কাজ করা হয়, তখন আশপাশে যাদের পেশিশক্তি আছে, রাজনৈতিক ক্ষমতা আছে, তারাও দখল শুরু করে৷ তাই হচ্ছে৷’’

ধানমন্ডির চারটি মাঠের সাথেই বড় বড় রাজনৈতিক নেতা জড়িত: আদিল মোহাম্মদ খান

কারা দখল করে?

আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, এই মাঠ দখল প্রক্রিয়ায় সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক ক্ষমতাবান ব্যক্তি, পেশিশক্তির অধিকারীরা জড়িত৷ আছেন জনপ্রতিনিধিরাও৷ তিনি বলেন, ধূপখোলা মাঠে সিটি কর্পোরেশন নিজেই মার্কেট বানাচ্ছে৷ ধানমন্ডিতে চারটি মাঠ, কিন্তু কোনো মাঠেই সাধারণের প্রবেশাধিকার নেই৷ আট নাম্বার মাঠে সাধারণের  প্রবেশের কোনো সুযোগ নেই৷ কলাবাগান মাঠে নিয়ন্ত্রণ আছে৷ আবাহনীসহ দুইটি মাঠে প্রবেশ নিয়ন্ত্রিত৷ তাহলে সাধারণের জন্য কোনো মাঠ নেই৷ ধানমন্ডি পরিকল্পিত একটি আবাসিক এলাকা৷ সেখানকার চারটি মাঠই এখন দখল হয়ে গেছে৷ আমি ওই এলাকার বাসিন্দা হিসেবে কাউন্সিলরের কাছে গিয়েছিলাম৷ তিনি মাঠগুলোতে জনসাধারণের প্রবেশের ব্যবস্থা করবেন বলেছিলেন, কিন্তু করতে পারেননি৷ আট নাম্বার মাঠ আদালতের নির্দেশে কিছুদিনের জন্য খুলে দেয়া হয়েছিল৷ পরে আবার বন্ধ করে দেয়া হয়৷

তার কথা, ‘‘যদি খেয়াল করেন, দেখবেন, ধানমন্ডির চারটি মাঠের সাথেই বড় বড় রাজনৈতিক নেতা জড়িত৷ সাধারণ মানুষ তাই অসহায়৷ তেঁতুলতলা মাঠের ঘটনা থেকেই বোঝা যায় মাঠ কারা দখল করে৷’’

তিনি বলেন, দুই ধরনের লোক মাঠ দখল করছেন৷ রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী এবং আর্থিক ও পেশিশক্তির অধিকারী যারা, তারা৷ আর বড় দখল দেখে ছোট দখলদারেরা উৎসাহিত হয়৷ বিভিন্ন এলকায় মাঠ দখল করে মার্কেট, বাজার, কাঁচাবাজার স্থাপনের পিছনে স্থানীয় রাজনৈতিক ও পেশিশক্তি এবং তাদের পেছনে আরো বড় শক্তি আছে৷

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)-র সভাপতি ড. মোহাম্মদ আবদুল মতিন বলেন, ‘‘ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের উল্টো দিকের পার্কটি এখন বলতে গেলে বন্ধ৷ ওখানে উন্নয়ন করা হয়েছিল৷ লোকজনের বসার ও হাঁটার জায়গা করা হয়েছে৷ এখন নাকি সেখানে আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিং করা হবে৷ তার উপরে মাঠ হবে৷ সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের নাকি গাড়ি পার্কিং-এর জায়গা নেই, তাই এসবের উদ্যোগ৷ আমি বুঝি না কীভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়৷’’

তার কথা, কিছু ঘটনা বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায় কারা মাঠ দখল করে৷ এটা একটা চক্র৷ এখানে ব্যক্তি আছে৷ প্রতিষ্ঠানও আছে৷ তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতাসহ নানা ধরনের ক্ষমতা আছে৷

তিনি বলেন, ঢাকা শহরের চারপাশ হাউজিং কোম্পানিগুলোকে দিয়ে দেয়া হচ্ছে৷ জলাধার, নদী এসব ভরাট করে তারা ভবন নির্মাণ করছে৷ সাধারণ মানুষের ক্ষতি করে তাদের হাতে ধরে ধনী বানানো হচ্ছে৷

শিশুরা কোথায় যাবে?

প্রধানমন্ত্রীর ‘অনুশাসন’ আছে যে, রাজধানীর প্রতিটি ওয়ার্ডে দুইটি করে মাঠ থাকতে হবে৷ কিন্তু কাগজে-কলমেও ঢাকার ৪১টি ওয়ার্ডে কোনো মাঠ নেই৷

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, শহরে প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য ৯ বর্গমিটার খোলা জায়গা দরকার৷ কিন্তু ঢাকা শহরে আছে এক বর্গ মিটারেরও কম৷ আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, এই শহরের নাগরিকদের কথা না ভেবে খোলা জায়গাগুলো দখল করা হচ্ছে৷ এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা৷ তারা সঠিকভাবে বেড়ে উঠতে পারবে না৷ মোবাশ্বের হোসেন মনে করেন, এর ফলে আমরা ভবিষ্যতে একটি হৃদয়হীন ও অসামজিক প্রজন্ম পাবো৷ যাদের দুনিয়া হবে টিভি ও মেবাইল ফোন৷ তারা বাস্তব দুনিয়া চিনবে না৷ আর আব্দুল মতিন বলেন, খোলা মাঠ আর সবুজ না থাকলে এক সময় জীবনও থাকবে না৷