1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ট্যাগের রাজনীতি : ‘রাজাকার' বনাম ‘ফ্যাসিস্ট'

সমীর কুমার দে ঢাকা
৩০ নভেম্বর ২০২৪

গত জুলাইয়ে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের টক শোতে আলোচক ছিলেন সাবেক বিচারপতি এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। অনুষ্ঠানে কথা বলার এক পর্যায়ে উত্তেজিত হয়ে তিনি উপস্থাপিকাকে ‘রাজাকারের বাচ্চা' বলে গালি দেন।

https://p.dw.com/p/4nbUL
ঢাকার সড়কে বিক্ষোভ
যেকোনো আন্দোলনেই 'আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্র' খুঁজে পাচ্ছেন অনেকেছবি: Abdul Goni

ঠিক একইভাবে সম্প্রতি বিভিন্ন সংগঠনের আন্দোলনের মধ্যে ‘ফ্যাসিস্ট এর দালাল' খুঁজে পাচ্ছেন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা। কেউ কেউ আন্দোলনকারীদের ‘ভারতের দালাল' বলছেন।

এই ধরনের ট্যাগের রাজনীতি থেকে বের হওয়ার উপায় জানতে চাইলে এমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, "যেটা প্রয়োজন সেটা হল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূল বিষয়টি হচ্ছে পরষ্পর সহনশীলতা। সেখানে বৈচিত্র থাকবে, সংগ্রাম থাকবে কিন্তু এগুলো ধংস্বাত্মক হবে না বা এক দলীয় হওয়ার চেষ্টা করবে না। তারা স্বৈরতান্ত্রিক হওয়ার দিকে এগুবে না। আমাদের শাসকরা ক্ষমতা পেলে অন্য কাউকে সহ্য করতে চান না। সেজন্য তারা এই ধরনের নাম দিতে থাকেন। এই নাম দিয়ে একে অপরকে পরাভূত করার চেষ্টা করতে থাকে বিপরীত শক্তিকে। বৈচিত্র সহ্য করতে না পারা আমাদের সমাজে একটা ব্যাধি, আমাদের রাজনীতিতেও একটা ব্যাধি। গ্রহণযোগ্য, অন্তর্ভূক্তিমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনও যদি হতো তাহলেও আমরা এই সংস্কৃতির দিকে এগুতে পারতাম। গত ৩০ বছরে জাতীয় নির্বাচন তো গ্রহণযোগ্য হয়নি, এমনকি ছাত্র সংসদের নির্বাচনও হয়নি। ফলে সেই স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব আছে। এটা গণতন্ত্রবিরোধী। এটা পরমত সহিষ্ণুতার পরিবর্তে পরমত দমনের চেষ্টা চলছে।”

‘পরমত সহিষ্ণুতার পরিবর্তে পরমত দমনের চেষ্টা চলছে’

ট্যাগের রাজনীতি কবে থেকে শুরু হয়েছে? এই রাজনীতিতে কি ধরনের প্রভাব পড়ে? বিশ্লেষকরা বলছেন, স্বাধীনতার পর থেকেই ট্যাগের রাজনীতি শুরু হয়েছে। তবে বিগত সরকারের সময় এটা ‘ক্যান্সারের' মতো ছড়িয়ে পড়েছে। ভিন্ন মত সহ্য করতে না পরার যে সংস্কৃতি সেটা বিগত আওয়ামী লীগের সময় চরম আকার ধারণ করে।

আওয়ামী লীগ না হয় এই ধরনের রাজনীতি করেছে। কিন্তু এই সরকারের সময়ও কেন এটা হচ্ছে? জানতে চাইলে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মূখপাত্র উমামা ফাতেমা ডয়চে ভেলেকে বলেন, "বিচার ব্যবস্থা সঠিক না হওয়ার কারণে এখনও এটা চলছে। আওয়ামী লীগ গণহত্যা চালিয়েছে, তাদের তো এখনও বিচার হয়নি। এ কারণে অনেকের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হচ্ছে। তারা তো এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা তো এই গণহত্যার সঙ্গে যুক্ত ছিল। এই ন্যারেটিভ থেকেই এখনও ট্যাগের বিষয়টি চলছে। আমি মনে করি, তাদের বিচার নিশ্চিত করা গেলে ট্যাগের রাজনীতি বন্ধ হবে।”

আওয়ামী লীগের বিচার হলেই কি ট্যাগের রাজনীতি বন্ধ হবে? এ প্রমঙ্গে মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এখানে যে জিনিসটা খুবই লক্ষণীয় সেটা হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক যে সংস্কৃতি, গণতন্ত্রকে সংকুচিত করার যে সংস্কৃতি সেটাকেই সবসময় আমরা দেখছি উলম্ফন দিতে। বিগত সরকারের আমলে আমরা দেখেছি, কারো বক্তব্য পছন্দ না হলে সরকারের তরফ থেকে তাকে রাজাকার, জামায়াত, শিবির, জঙ্গি এই ধরনের ট্যাগ দিতে। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখছি, স্বৈরাচারের দোসর, স্বৈরাচার, ভারতের দালাল ঢালাওভাবে এই ধরনের ট্যাগ দেওয়া হচ্ছে। এর প্রধানতম কারণ হচ্ছে, ওই ব্যক্তিকে সমাজে কোনঠাসা করে দেওয়া। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কোনঠাসা করার এক ধরনের সংস্কৃতি দীর্ঘদিন ধরে আমরা লক্ষ্য করছি। এর ব্যাপকতা পেয়েছে, বিগত সরকারের সময়ে, অর্থাৎ ১৫-১৬ বছরে, যা এখনো বহমান। শুধুমাত্র শব্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রে কিছু নতুন নতুন শব্দ দেখছি। এর মূল কারণ হচ্ছে মানুষের কন্ঠরোধ করা। মানুষকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেওয়া। যাতে ওই মানুষটি সমাজে আর স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে না পারে।”

ট্যাগ দেওয়া বা অযথা দোষারোপের নেতিবাচক দিকগুলো সমাজে বিভাজন এবং সামাজিক সম্পর্কের অবক্ষয় সৃষ্টি করে। সমাজ গবেষকদের মতে সমাজে কিছু ব্যক্তিকে ‘কলঙ্কিত' করে তাদের সামাজিক মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করার মাধ্যমে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে প্রান্তিক করে। এরূপ দোষারোপের ফলে সামাজিক সংকট ও বিভাজন তৈরি হয়, যা সামাজিক অস্থিরতা এবং সহিংসতার জন্ম দিতে পারে।

এই অবস্থা কি চলতেই থাকবে, কিভাবে পরিত্রাণ মিলবে- জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আলা উদ্দিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, "বের হওয়ার পথ হলো নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করার শক্তি নিজের মধ্যে সঞ্চার করতে হবে। যেটা আমরা হারিয়ে ফেলেছি। যে কোন মতান্তর, ভিন্নতা এই বিষয়গুলো নিরপেক্ষভাবে দেখবার যে শক্তি সেটা আমরা হারিয়ে ফেলেছি। হারানো শক্তিটাকে আমাদের উদ্ধার করতে হবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির গুনগত পরিবর্তন যদি না হয় তাহলে নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করার শক্তি ফেরত আসবে না। গণতান্ত্রিক মনোভাব, জবাবদিহিতা যদি নিশ্চিত হয় তাহলে রেষারেষি প্রতিহিংসা এগুলো প্রকট রূপ ধারণ করে না। এগুলো যখন প্রকট রূপ ধারণ করে অর্থাৎ আপনি যদি অধিকার বঞ্চিত হন বা গণতান্ত্রিক চর্চা না থাকে তখন এগুলো হলো একজনকে ঘায়েল করার বড় ধরনের মেকানিজম। যদি গণতন্ত্র থাকে বা জবাবদিহিতা থাকে তাহলে ওদিকে যাওয়াই লাগে না।”

‘স্বৈরাচার, ভারতের দালাল ঢালাওভাবে এমন ট্যাগ দেওয়া হচ্ছে’

কেউ যদি ট্যাগিংয়ের শিকার হন তিনি কি আইনগতভাবে কোন প্রতিকার পেতে পেতে পারেন? জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জোর্তিময় বড়ুয়া ডয়চে ভেলেকে বলেন, "সরাসরি ট্যাগিংয়ের কারণে প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ কম। কারণ আমাদের আইনগুলো যখন হয়েছে তখন এই বিষয়গুলো ছিল না। তবে কাউকে ট্যাগ দেওয়ার ফলে তিনি যদি হামলার শিকার হন বা চাকরিচ্যুত হন তাহলে দন্ডবিধি ও ফৌজদারি আইনে প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ আছে। আবার চাইলে কেউ মানহানির মামলাও করতে পারেন। সেই সুযোগ আছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ ট্যাগিংয়ের শিকার হয়ে প্রতিকার চাইতে আদালতে আসেননি।”

যাদের নিজেদের উপর আস্থা নেই তারা ভিন্ন মতের কাউকে এই ধরনের ট্যাগ দেওয়ার চেষ্টা করেন বলে মনে করেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, "নিজেদের কাজ নিয়ে যদি যথেষ্ট আস্থা না থাকে তখন এই ধরনের ট্যাগের বিষয়টি চলে আসে। যেহেতু আওয়ামী লীগ নিজেরা অনেক রকম অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিল, যখন তাদের বিরুদ্ধে সমালোচনা হতো তখন জবাব দেওয়ার সক্ষমতা থাকতো না তাদের। তখন তারা বিএনপি-জমায়াত বলে আক্রমন করার চেষ্টা করেছে। এটা এতবার ব্যবহার হয়েছে, যাতে এর আর কোন কার্যকারিতা ছিল না। এখন যখন আমরা ট্যাগের রাজনীতি দেখি, সেটা আমাদের জন্য দুঃখজনক এবং হতাশাব্যাঞ্জক। কারণ ওই ভূমিকাটা এখনও একটু একটু দেখা যাচ্ছে। এগুলো যারা ব্যবহার করে এটা তাদের দূর্বলতার পরিচয় বহন করে। কারণ ভূমিকা নিয়ে দ্বিমত থাকলে সেটাই পরিস্কার করে বলা উচিৎ। ট্যাগ দেওয়াটা দুর্বলতার লক্ষন। এইটার পুনাবৃত্তি হতে থাকলে খুবই ক্ষতিকর হবে। এটাতে বিভক্তি বাড়ায়, ভুলবোঝাবুঝি বাড়ায়। মানুষের মধ্যে বিদ্বেষ বাড়ায়। বিদ্বেষ বাড়ানোর রাজনীতি কতটা ক্ষতিকর হতে পারে সেটা আমরা আগে দেখেছি। ফলে এখন এই জায়গা থেকে বের হতে হবে।”

বিগত সরকারের সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে ভিন্নমতের মানুষকে নানা ধরনের ট্যাগ দিয়ে আক্রমণ করতে দেখা গেছে। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের নেতারাও কারও বক্তব্য পছন্দ না হলে তাকে ‘জামায়াত বা শিবির' ট্যাগ দিয়েছেন। এখনও দেখা যাচ্ছে, যে সব আন্দোলন হচ্ছে সেখানে ‘ফ্যাসিস্টের' অবস্থান খুঁজে পাচ্ছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। আনসারদের আন্দোলন থেকে শুরু করে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সা চালকদের আন্দোলনের পেছনেও ‘ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের' ষড়যন্ত্রের কথা বলেছেন বেশ কয়েকজন সমন্বয়ক। এর বাইরে যে কোন ঘটনার জন্যও ‘ফ্যাসিস্ট' এর বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। জামায়াতের আমীর সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, তিনি ‘ফ্যাসিস্ট' শব্দটা আর শুনতে চাচ্ছেন না।

এই যে ট্যাগিংয়ের রাজনীতি সেখান থেকে কিভাবে মুক্তি মিলতে পারে? জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমাদের দেশে রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিপরীত মতামত যিনি প্রকাশ করেন বা যারা ক্ষমতায় থাকেন তাদের মতের সঙ্গে না মিললেই তাকে নানাভাবে হেয় করা হয়। এটা দীর্ঘদিন ধরে চলছে। হেয় করার ক্ষেত্রে যে কাজটি সবচেয়ে বেশি করা হয় সেটি হল বিপরিত মতের লোকটিকে ওইভাবে উপস্থাপন করানো। এটা অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সবাইকে নিয়ে চলেতে হবে সেটিই নিয়ম। বিগত সরকারের সময় বিরোধী মতের লোককে নানাভাবে ট্যাগ দিয়ে হেয় করার যে বাস্তবতা দেখেছি এখনও কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেই প্রক্রিয়া দেখছি। আমাদের রাষ্ট্র সংস্কারের কয়েকটি ধরনের মধ্যে ভিন্ন মতের মানুষের যেভাবে বিচার করা হয় সেখানে আমাদের মনত্বাতিক সংস্কার প্রয়োজন। এটা না হলে সাম্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠনের চিন্তাটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।”