জোড়া পরীক্ষার সাঁড়াশিতেই কি ডাক্তারি পড়ুয়াদের মৃত্যুফাঁদ?
৪ আগস্ট ২০২২একের পর এক আত্মহত্যা
গত সোমবার আত্মঘাতী হন কলকাতার ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের ডাক্তারি পড়ুয়া প্রদীপ্তা দাস৷ মেডিকেলের চূড়ান্ত বর্ষের এই ছাত্রীর দেহ উদ্ধার হয়৷ ৩০ জুলাই এনআরএস মেডিকেল কলেজের ছাত্র অনুপ ঢেলিয়া আত্মহত্যা করেছেন৷ হাওড়ায় নিজের বাড়ির ছাদ থেকে তিনি ঝাঁপ দেন৷ সপ্তাহ তিনেক আগে রামপুরহাট মেডিকেল কলেজের আর এক ছাত্রী নিজের বাড়িতে আত্মঘাতী হন৷ কেন ক্রমশ বাড়ছে ডাক্তারি পড়ুয়াদের আত্মঘাতী হওয়ার প্রবণতা?
সমাজের চোখে এখনো সবচেয়ে সম্মানজনক পেশা চিকিৎসকের৷ তাই উচ্চ মেধাসম্পন্ন ছাত্রছাত্রীদের বড় অংশের লক্ষ্য থাকে ডাক্তার হওয়া৷ এই ডাক্তারি পড়ার সময় তাঁরা এতটাই মানসিক চাপে পড়ছেন যে তাঁদের আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হচ্ছে৷ কোনো ব্যক্তিগত কারণ থাকতেই পারে, তবে ঘনিষ্ঠ মহলের বয়ান অনুযায়ী পড়াশোনা সংক্রান্ত চাপ এই চূড়ান্ত পদক্ষেপের নেপথ্যে সবচেয়ে বড় কারণ৷
জোড়া পরীক্ষার চাপ
এই পর্বে আলোচনার কেন্দ্রে নয়া পরীক্ষা৷ ন্যাশনাল মেডিকেল কমিশনের নিয়মে অনুযায়ী আগামী বছর থেকে এমবিবিএস-এর চূড়ান্ত বর্ষের পরীক্ষার সঙ্গে জাতীয় স্তরের একটি পরীক্ষা হতে চলেছে৷ গুরুত্বপূর্ণ এই পরীক্ষার ফলাফলের উপর নির্ভর করছে হবু চিকিৎসকদের ভবিষ্যৎ৷ কলকাতা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের চূড়ান্ত বর্ষের পড়ুয়া অয়ন চট্টোপাধ্যায় বলেন, "আমাদের ফাইনাল ইয়ারে মোটামুটি চারটি বিষয়ে পড়াশোনা করতে হয়৷ নতুন যে পরীক্ষাটা দিতে হবে, তাতে প্রথম থেকে ফাইনাল ইয়ার পর্যন্ত যে ১৯টা বিষয় পড়েছি, সবটা নিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হবে৷ তার সঙ্গে তথ্য সংগ্রহ ও তা মুখস্থ করার উপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে৷ এর সঙ্গে ডাক্তার হয়ে ওঠার সম্পর্ক খুব একটা নেই৷” পড়ুয়াদের দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন করা ছাত্রনেতা, ডা. শামস মুসাফির বলেন, "পাঠ্যসূচিতে পরিবর্তন ও নতুন পরীক্ষার ফলে ছাত্রছাত্রীরা চাপে পড়ে যাচ্ছেন৷ আমাদের সময়ের থেকে সিলেবাস ক্রমশ বদলে যাচ্ছে, এর ফলে চাপ সহ্য করতে না পেরে আরও মানসিক অবসাদে চলে যাচ্ছেন পড়ুয়ারা৷”
সমীক্ষার ফলে অবসাদের চিহ্ন
পড়াশোনা নিয়ে চাপের কথা প্রদীপ্তা বা অনুপের সহপাঠীরা স্বীকার করে নিচ্ছেন বলে তাদের ঘনিষ্ঠ মহল থেকে জানা যাচ্ছে৷ সে কারণে পশ্চিমবঙ্গ স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে গত জানুয়ারি থেকে৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে হেল্পলাইন নম্বর দেয়া হয়েছে৷ মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ সম্বলিত ভিডিও দেখানো হয় ইউটিউব চ্যানেলে৷ সোশ্যাল মিডিয়ায় সমীক্ষাও চালানো হয়৷ চিকিৎসাশাস্ত্রের পঠনপাঠনে সঙ্গে যুক্ত হাজার ছয়েক পড়ুয়া একটি সমীক্ষা ফর্ম অনলাইনে পূরণ করে জমা দেন৷ তাতে দেখা যাচ্ছে , ১০ শতাংশ পড়ুয়ার মধ্যে গভীর অবসাদ রয়েছেন, যার একাংশ আবার আত্মহত্যাপ্রবণ৷ বিষয়টি স্বাস্থ্য ভবনকে চিঠি দিয়ে জানায় স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়৷ তার পরও প্রদীপ্তা বা অনুপের মৃত্যু ঠেকানো যায়নি৷
কাউন্সেলিং কি পর্যাপ্ত?
প্রদীপ্তার মৃত্যুর পর পশ্চিমবঙ্গ স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুহৃতা পালের প্রতিক্রিয়া, "আমরা কি হেরে যাচ্ছি? ছেলেমেয়েদের মানসিক স্বাস্থ্য যাতে ঠিক থাকে, তার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে৷ তারপরেও এমন ঘটনা ভীষণ দুঃখের৷” যদিও চলতি প্রশিক্ষণ বা কাউন্সেলিং ব্যবস্থা সম্পর্কে খুব একটা আশাবাদী নন চিকিৎসকদের একাংশ৷ ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরাম-এর সদস্য ডা. পুণ্যব্রত গুণ ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমরা যখন পড়েছি, তার তুলনায় এখন প্রতিযোগিতা অনেক বেশি৷ তার উপর যে মানসিক চাপ তৈরি হচ্ছে, সেটা মোকাবিলা করার ঠিকঠাক ব্যবস্থা নেই৷ একটা কার্যকরী, উন্নত কাউন্সেলিং ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার৷ পড়ুয়ারা সমস্যায় পড়লে বাবা-মা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছেন৷ এই কাজটা প্রতিষ্ঠানকে আরো নিবিড়ভাবে করতে হবে৷”
একলা ঘর আমার দেশ…
আত্মহত্যা ঠেকাতে চেষ্টা চলছে৷ ‘গেট কিপার'-এর মতো অভিনব প্রশিক্ষণ চালু করা হয়েছে৷ কোনো পড়ুয়া অবসাদে ভুগলে বা তার মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা তৈরি হলে সেটা কিছু লক্ষণে প্রকাশ পায়৷ এই লক্ষণ সম্পর্কে ছাত্রছাত্রীদের পরিচিত করাতে রাজ্যের মেডিকেল কলেজ-সহ স্বাস্থ্য-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘গেট কিপার' প্রশিক্ষণ চালু রয়েছে৷ কিন্তু অনুপ-প্রদীপ্তাদের ক্ষেত্রে সেই লক্ষণ কি চোখে পড়েনি? ডাক্তারি পড়ুয়া অয়নের বক্তব্য, "সবাই আত্মকেন্দ্রিক আর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে৷ শুধু নিজেরটা বুঝে নিতে হবে৷ প্রতিযোগিতা এমনই৷ অন্যের দিকে কে লক্ষ্য রাখছে? সবাই তো দৌড়ে সামিল!