ভারতে চালু হচ্ছে জিএসটি
৩০ জুন ২০১৭প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যে সমস্ত পণ্য-পরিষেবা ব্যবহার করা হয়, তার প্রায় সব কিছুরই দাম নির্ধারন করবে জিএসটি৷
‘এক দেশ, এক কর’— স্লোগানকে সামনে রেখে জিএসটি চালু করতে সংসদের সেন্ট্রাল হলে জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে নরেন্দ্র মোদী সরকার৷ জিএসটি'র পুরো নাম ‘গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স’ বা পণ্য-পরিষেবা কর৷ ভারতে স্বাধীনতার পরে পরোক্ষ কর ব্যবস্থায় এত বড় সংস্কার আগে হয়নি৷ আলোচনা শুরু হয়েছিল ১৭ বছর আগে৷ অটল বিহারী বাজপেয়ীর জমানায়৷ বিস্তর দর কষাকষি আর আলাপ-আলোচনার পরে তা চালু হচ্ছে ১ জুলাই থেকে৷ এই করের প্রভাব পড়বে নিত্যদিনের ব্যবহার্য্য জিনিসের ওপর৷ সে বিমানের টিকিট হোক বা প্যাকেটবন্দি আটা৷ রেস্তোরাঁর বিল হোক বা মোবাইলের রিচার্জ৷
বিভিন্ন জিনিসের ওপর করের হার নির্ধারিত হয়েছে ছয়টি— শূন্য, ০.২৫%, ৫%, ১২%, ১৮% এবং ২৮%৷
স্বাধীনতার পর থেকে এটাই চতুর্থ মধ্যরাতের অনুষ্ঠান৷ প্রথম বার সেন্ট্রাল হল সেজে উঠেছিল স্বাধীনতার সময় ১৯৪৭–এর ১৪ ও ১৫ আগস্টের মধ্যরাতে৷ সেবার সংসদের সেন্ট্রাল হলে স্বাধীনতার ভাষণ ‘ট্রিস্ট উইথ ডেস্টিনি’ পেশ করেছিলেন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু৷ তারপর স্বাধীনতার ২৫ বছর ও ৫০ বছর পূর্তিতে একইভাবে মধ্যরাতে অনুষ্ঠান হয়েছে৷ এবার সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তকে ছুঁতে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী৷ রাত ১১টা থেকে ১ ঘণ্টার অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে সংসদের সেন্ট্রাল হলে৷ দু’ মাসেরও বেশি সময় ধরে বহু কারিগর সাজিয়ে তুলেছেন সংসদ ভবনের এই গুরুত্বপূর্ণ হলটিকে৷ অনুষ্ঠানের শুরুতেই জিএসটি নিয়ে দু'টি স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি পরপর দেখানো হবে৷ তারপর জিএসটি নিয়ে বক্তব্য পেশ করবেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী৷ জিএসটি চালু হওয়ার প্রথম দু’ মাস পর্যন্ত দেরিতে রিটার্ন দাখিলের সুবিধা চালু রাখছে সরকার৷ কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি জানিয়েছেন, ‘‘এখনও পর্যন্ত গোটা দেশের মোট ৬৫ লক্ষ ব্যবসা নিজেদের জিএসটি-তে নথিভুক্ত করেছে৷’’
জেটলির মতে, ‘‘এই করব্যবস্থা ঐতিহাসিক পদক্ষেপ৷ সংসদের দীর্ঘ বিতর্কের পর বিল পাস হয়েছে৷ ২৯টি রাজ্য, কেন্দ্র এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির অর্থমন্ত্রীদের নিয়ে গঠিত জিএসটি কাউন্সিল বহুবার বৈঠক করে সহমতের ভিত্তিতে এই করের খুঁটিনাটি খসড়ায় অনুমোদন দিয়েছে৷ তাতে উপকৃত হবে গোটা ভারত৷’’
প্রতি ক্ষেত্রেই পণ্য বা পরিষেবা যেখানে জোগান দেওয়া, তথা কেনা-বেচা হচ্ছে, জিএসটি বসবে সেখানে৷ জিএসটি চার নামের হবে—
১. কেন্দ্রের বসানো জিএসটি (সিজিএসটি)
২. রাজ্যের বসানো জিএসটি (এসজিএসটি)
৩. কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের বসানো জিএসটি (ইউটিজিএসটি)
৪. ইন্টিগ্রেটেড বা সম্মিলিত জিএসটি (আইজিএসটি)
এদিকে, তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জি-সহ জিএসটির সূচনা লগ্নের অনুষ্ঠান বয়কটের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কংগ্রেস এবং প্রায় সব বিরোধী দল৷ অনুষ্ঠানে থাকছেন না মনমোহন সিং, যিনি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন প্রথম জিএসটির পরিকল্পনা করা হয়েছিল৷
কংগ্রেসের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, ৩০ জুন মধ্যরাতে সংসদের বিশেষ অনুষ্ঠানে তারা অংশগ্রহণ করবে না৷ জিএসটির তড়িঘড়ি বাস্তবায়নের বিরোধিতা করে বুধবারই সংসদে সেন্ট্রাল হলে মধ্যরাতের সূচনা অনুষ্ঠান বয়কটের কথা ঘোষণা করেছিলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী৷ পাশে দাঁড়িয়েছে সিপিএম, সিপিআই, সপা, বসপা-র মতো বিরোধী দলগুলিও৷
রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা এবং প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গুলাম নবি আজাদ জানিয়েছেন, ‘‘মূলত দুটি কারণে কংগ্রেস এই অনুষ্ঠান বয়কটের সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ প্রথম কারণ, এর আগে সংসদের সেন্ট্রাল হলে মাঝরাতে যে তিনটি অনুষ্ঠান হয়েছে, সেগুলির সব ক'টিই স্বাধীনতা দিবস সম্পর্কিত৷ প্রথমবার ১৯৪৭-এর ১৫ আগস্ট৷ দ্বিতীয় বার '৭২-এ স্বাধীনতা দিবসের ২৫ বছর পূর্তিতে৷ তৃতীয় বার '৯৭ সালে ৫০ বছর উদ্যাপন উপলক্ষ্যে৷ অন্য কারণটি হলো, মোদী সরকারের জমানায় কৃষক আত্মহত্যা, দলিত হত্যা, নারী নির্যাতন, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, কাশ্মীর সমস্যা, গণপিটুনিতে হত্যা এবং জিডিপি পতন মারাত্মক আকার নিয়েছে৷’’
প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, লোকসভার কংগ্রেস নেতা মল্লিকার্জুন খাড়গে বলছেন, ‘‘কংগ্রেস জমানায় এমন বহু জনমুখী প্রকল্প চালু হয়েছে৷ কখনও সংসদের সেন্ট্রাল হলে মধ্যরাতে জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের কথা ভাবেনি তৎকালীন সরকার৷ কারণ, নিজেদের প্রচার নয়, বরং মানুষের কথা ভেবেছে কংগ্রেস৷’’
ওই অনুষ্ঠান ইতিমধ্যেই বয়কট করেছে তৃণমূল, সিপিএম এবং সিপিআই৷ বাকি বিরোধী দলগুলিও সমর্থন করেছে কংগ্রেসকে৷
কংগ্রেসের প্রবীন নেতা আনন্দ শর্মা বলছেন, ‘‘একটানা ১০ বছর ধরে যিনি জিএসটির বিরোধিতা করে এলেন, এখন তিনিই বিরোধীদের জিএসটির ভালো দিক নিয়ে জ্ঞান দিচ্ছেন!’’
কেন্দ্রের দাবি– দাম কমবে বহু পণ্য-পরিষেবার, যেমন— চাল, গমসহ প্রায় সমস্ত খাদ্যশস্য, ডাল, আটা, ময়দা, বেসন, পূজা সামগ্রী, দুধ, তাজা শাকসব্জি, ফল, মুড়ি, নুন, জৈব সার, উল, চিনি, চা, কফি, গুঁড়ো দুধ ইত্যাদি৷ চিনি, চা, কফি, গুঁড়ো দুধ, স্মার্ট ফোন, বস্তাবন্দি সিমেন্ট, অ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি, আয়ুর্বেদিক থেকে ইউনানি, প্রায় সব রকম ওষুধ তৈরির উপকরণ, চিকিৎসা ও অস্ত্রোপচারের যন্ত্রপাতি, কেবল্ টিভি পরিষেবা, ডিটিএইচও থাকছে এই তালিকায়৷
উল্টো দিকে, শিল্পমহলের দাবি, দাম বাড়বেও বেশ কিছু জিনিসের৷ যেমন, কম ও মাঝারি দামের গাড়ি, মোবাইলে টাকা ভরার খরচ, বিমার প্রিমিয়াম, ফ্রিজ-টিভির মতো বৈদ্যুতিন পণ্য, দামি হোটেলের ভাড়া, সোনার গয়না ইত্যাদি৷ অর্থাৎ, কিছু জিনিসের দাম বাড়বে৷ কমবেও কিছু পণ্য-পরিষেবার৷ যদিও শেষমেশ কী হবে, তা বোঝা যাবে জিএসটি চালু হলে৷