ছোটরা কীভাবে সময় কাটায়?
৬ ডিসেম্বর ২০১৬জার্মানি একটি শিল্পোন্নত, সমৃদ্ধ দেশ৷ এখানে যত না সমস্যা, তার চাইতে বেশি জরিপ৷ ওদিকে প্রযুক্তি যেভাবে সমাজ ও জীবনধারাকে বদলে দিচ্ছে, তাতে জরিপওয়ালারা হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন৷ তার উপর আছে নানা সরকারি সিদ্ধান্ত, যেমন দুপুর একটা বা দু'টো পর্যন্ত স্কুল করার চেয়ে, সারাদিনের স্কুল; অথবা ১৩ বছরে ‘আবিটুর' বা ফাইনাল পরীক্ষা করার চেয়ে, ১২ বছরে ফাইনাল পরীক্ষা, যার ফলে পড়ার আর হোমওয়ার্কের চাপ বাড়ে৷ এর ওপর যদি তথাকথিত ‘হেলিকপ্টার' বাব-মায়েরা যুক্ত হন...৷
হেলিকপ্টার বাবা-মা হচ্ছেন তারা, যারা সর্বক্ষণ সন্তানের চারপাশে ঘুর-ঘুর করেন; সন্তান যাতে সর্বগুণধর বা সর্বগুণবতী হয়, সেজন্য তারা সব কিছু করতে প্রস্তুত: এই ছেলেকে টেনিস প্রশিক্ষণে নিয়ে যাচ্ছেন তো ঐ মেয়েকে বেহালা বাজানোর ক্লাশে পৌঁছে দিচ্ছেন; ছেলে যাচ্ছে টিউটোরিয়াল হোমে তো মেয়েকে পাঠাচ্ছেন হ্যান্ডিক্রাফ্টস শিখতে৷ স্কুল আর বাবা-মার উচ্চাকাঙ্খার ডবল চাপে পড়ে ছেলে-মেয়েদের ‘ফ্রাইৎসাইৎ', অর্থাৎ অবসর সময় কিন্তু ক্রমেই কমে আসছে৷ ২০১১ থেকে ২০১৩, এই তিন বছরে ১৪ থেকে ১৭ বছরের কিশোর-কিশোরীদের হাতে অবসর সময় কমেছে দিনে ৪৯ মিনিট৷
স্বদেশের সঙ্গে তুলনা করবেন না
উপমহাদেশে সম্ভাবনা কম, প্রতিযোগিতা বেশি৷ সেখানকার কচিকাঁচারা পরিশ্রম করতে জানে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও তার ব্যতিক্রম নয়৷ অবশ্য উচ্চাদর্শ থেকে বাস্তব পরিস্থিতির দূরত্বও সেই অনুপাতে বেশি৷ তবুও বলব, স্বদেশের ‘ভালো ছেলেরা' – এবং মেয়েরা – যে পরিমাণ পড়াশুনো করে, যে ধরনের কঠিন পরীক্ষা দিয়ে, যে ধরনের যোগ্য প্রতিযোগীদের পিছনে ফেলে নিজেকে ‘খানিকটা' এগিয়ে নিয়ে যায় – তার তুলনায় জার্মান শৈশব কৈশোর সত্যিই ছেলেবেলা এবং ছেলেখেলা৷ তফাৎ খালি একটি৷
এদেশে মানুষের হাতে টাকা অনেক, সময় কম৷ দেশের ৭০ ভাগ মানুষই মধ্যবিত্তের পর্যায়ে পড়েন, স্বদেশের তুলনায় যা উচ্চবিত্ত বলে মনে হলে আমাদের দোষ দেওয়ার কিছু নেই! স্কুল ছাড়ার পর পরই বাড়ি ছাড়া এখানে স্বাভাবিক, কালে তথাকথিত ‘আণবিক পরিবার', অর্থাৎ বাবা, মা ও একটি বা দু'টি সন্তান, যারা থাকেন একটি তিন থেকে চার কামরার ফ্ল্যাটে, কোন শহরে সেটা নির্ভর করে বাবা কিংবা মায়ের চাকুরির উপর৷ সেই শহরেই স্কুলে যায় ছেলে-মেয়েরা, মানুষ হয় সেই শহরের ছেলে-মেয়েদের মতো, নয়ত বিশ্বায়িত বিশ্বের স্মার্টফোনাসক্ত, ভিডিও গেমস খেলুড়ে, টেলিভিশন সিরিয়াল দেখে মানুষ হওয়া ছেলে-মেয়েদের মতো৷
এখানে ছেলে-মেয়েদের যতোটা না অবসর, তার চেয়ে বেশি স্বাধীনতা: তারা সেই অবসর নিয়ে যে কি করবে, সেটা নির্ধারণ করার স্বাধীনতা৷ এবং যেহেতু তারা এই স্বাধীনতায় অভ্যস্ত, সেহেতু তারা সেই স্বাধীনতার দায়িত্ব নিতেও প্রস্তুত৷ বস্তুত তারা কাজের বদলে শুধু অকাজ, কিংবা কিছু না করলেও, তার ফলশ্রুতি মারাত্মক কিছু একটা হয় না৷ তা সত্ত্বেও অধিকাংশ কিশোর-কিশোরী নিজেরাই তাদের গণ্ডী ও লছমনরেখা এঁকে নেয়, পরিমিতি ও অনুপাত বোঝে, ছেলেবেলার স্বাধীনতাও যে ভবিষ্যতের দায়িত্ব নেওয়ার পথে প্রথম পদক্ষেপ, সেটা যেন তারা স্বভাবগতভাবে বোঝে৷
উপমহাদেশের সঙ্গে মূল ফারাকটা বোধহয় এইখানেই: ছোটরা কিভাবে তাদের অবসর বিনোদন করবে, কোন পদ্ধতিতে বা কোন কোন ‘গ্যাজেট' নিয়ে মেতে থাকবে, সেটা প্রশ্ন নয়৷ প্রশ্ন হলো, তারা স্বাধীনচেতা মানুষ হিসেবে গড়ে উঠছে কিনা; প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে অপরের দায়িত্ব নেবার আগে নিজের দায়িত্ব নিতে শিখছে কিনা৷ ভেসে যেতে চাইলে এদেশে তাদের সবাই ভেসে যেতে পারে, কিন্তু সেটা তারা করে না৷ তাদের সমাজ জেনেশুনেই এই ঝুঁকিটা নেয়৷ ছেলে মানুষ করার ব্যাপারে আমরা এদের কাছ থেকে শুধু বাঁধন নয়, বরং মুক্তির ব্যাপারটাও শিখতে পারি৷
অরুণ শঙ্কর চৌধুরীর লেখাটি আপনার কেমন লাগলো? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷