চিকিৎসায় পরিবর্তন আনছে এমআরএনএ প্রযুক্তি
২১ জুন ২০২২মাটিয়াস হেনৎসে কয়েক দশক ধরে এমআরএনএ নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন৷ জার্মানির হাইডেলব্যার্গ শহরে ইউরোপীয় আণবিক জীববিজ্ঞান গবেষণাগারের প্রধান হিসেবে এই গবেষণা সম্পর্কে এত মানুষের আগ্রহ তার কাছে নতুন অভিজ্ঞতা৷ হেনৎসে বলেন, ‘‘করোনা মহামারির আগে সান্ধ্যভোজনের টেবিলে বসে এমআরএনএ নিয়ে কোনো প্রশ্ন শুনতে হতো না৷''
আমাদের শরীরে এমআরএনএ-র একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে৷ কারণ সেটি সচল হওয়ায় শরীরের নীল নক্সার মধ্যে পরিবহণের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে৷ এমন ব্লুপ্রিন্ট আমাদের শরীরের হার্ড ডিস্ক, অর্থাৎ ক্রোমোজোমের ডিএনএ-তে জমা থাকে৷ সেখানে সেগুলি অক্ষত থাকে৷ প্রোটিন তৈরি করতে গেলে জিনগত তথ্য অনুবাদ করতে হয়৷
এমআরএনএ-র মধ্যেও একই তথ্য থাকে, তবে সেটি ব্লু প্রিন্টের পরিবহণের মাধ্যম হিসেবে গতিশীল৷ এমআরএনএ নিউক্লিয়াস থেকে বেরিয়ে যায় এবং রাইবোসোমে তথ্য নিয়ে আসে৷ সেখানে এমআরএনএ-র পাঠোদ্ধার করা হয়৷ যে জিনগত তথ্য প্রেরণ করা হয়, সেগুলির ভিত্তিতে সব রকম সম্ভাব্য প্রোটিন তৈরি করা যায়৷ শরীরের প্রায় সব প্রক্রিয়ার জন্যই সেই প্রোটিনের প্রয়োজন হয়৷
গবেষক মহলে বহুকাল ধরে এমআরএনএ অবহেলার পাত্র ছিল৷ রাসায়নিক মানদণ্ডে ডিএনএ-র সঙ্গে পার্থক্য সত্ত্বেও সেটি আরো অনেক স্থিতিশীল বলে সহজে কাজে লাগানো যায়৷ মাটিয়াস হেনৎসে বলেন, ‘‘অনেককাল আগে ডিএনএ সম্পর্কে রোমাঞ্চকর তথ্য পাওয়া গিয়েছিল৷ সে তুলনায় স্বীকৃতি পেতে এরএনএ-কে কিছুটা বেগ পেতে হয়েছে৷ তবে গত কয়েক বছরে এমআরএনএ অবিশ্বাস্য গতিতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসে পড়েছে৷''
কিন্তু এমন মানুষও ছিলেন, যারা শুরু থেকেই এমআরএনএ প্রয়োগের সম্ভাবনায় বিশ্বাস করেছিলেন৷ ইংমার হ্যোর তাদেরই একজন৷ ট্যুবিঙেন শহরে পিএইচডি করার সময় তিনি আবিষ্কার করেছিলেন যে, সব তথ্যসমৃদ্ধ এমআরএনএ কোনো বিশেষ মোড়ক ছাড়াই কোষের মধ্যে আনা সম্ভব৷ প্রথমে মনে হয়েছিল, তিনি বোধহয় কোনো ভুল করেছেন৷ স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে হ্যোর বলেন, ‘‘তখন সত্যি সব কিছু আবার নতুন করে করলাম৷ ঠিকমতো সব লিখে নিখুঁতভাবে পরীক্ষা করলাম৷ কিন্তু সেই একই ফল পেলাম৷ সেটা ছিল সত্যি এক ‘ইউরেকা' মুহূর্ত৷ মনে হয়েছিল, সত্যি যদি উন্মুক্ত ও অসুরক্ষিত এরএনএ কাজে লাগানো সম্ভব হয়, সেটা গোটা বিশ্ব নাড়িয়ে দেবে৷''
হ্যোর পরে সহকর্মীদের সঙ্গে কিউরভ্যাক নামের কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন৷ চিকিৎসাবিদ্যার ক্ষেত্রে এমআরএনএ-র প্রয়োগ বিশাল সুবিধা আনতে পারবে বলে তার মনে হয়েছিল৷ ইংমার হ্যোর বলেন, ‘‘এখন অন্য কোনো টিকা পরিবর্তন করতে হলে দীর্ঘ সময় ধরে প্রাণীর উপর পরীক্ষা চালাতে হয়৷ তারপর সেটির প্রভাব খতিয়ে দেখতে হয়৷ এমআরএনএ-র ক্ষেত্রে শুধু সিকোয়েন্স বা অনুক্রম বদলে দিলেই চলে, অর্থাৎ অক্ষরের ক্রম৷ শরীরের সঙ্গে কার্যত সংলাপ চালানো যায়, যা এক স্বপ্নের মতো৷ উৎপাদনের প্রক্রিয়া অপরিবর্তিত থাকে৷ কোনো আরএনএ পোলিও না করোনার মোকাবিলায় তৈরি করা হচ্ছে, তাতে কিছুই এসে যায় না৷ উৎপাদন প্রক্রিয়া একই থাকে৷''
কারণ গবেষকরা কোনো প্রোটিনের জেনেটিক সিকোয়েন্সিং জানলেই বর্তমানে তাঁরা সেই অনুযায়ী এমআরএনএ সৃষ্টি করতে পারেন৷ কৃত্রিমভাবে সেটি তৈরি করে, মোড়কে পুরে শরীরে প্রবেশ করানো হয়৷ শরীর তখন নির্ধারিত প্রোটিন উৎপাদন করে৷
করোনা টিকার মূলমন্ত্রও সেই একই রকম৷ এ ক্ষেত্রে শরীর ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন তৈরির নির্দেশিকা গ্রহণ করে এবং সেই অনুযায়ী প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে প্রশিক্ষণ দেয়৷
প্রথম দিকে কিন্তু সমস্যা ছিল৷ কারণ, এমআরএনএ যখন বিনা বাধায় শরীরে মধ্যে চলাচল করে, তখন শরীর সেটিকে আগন্তুক হিসেবে গণ্য করে৷ ফলে অ্যালার্ম চালু হয়ে যায়৷
কাটালিন কারিকো ও তার সহকর্মী ড্রিউ ওয়াইসমান সেই সমস্যার সমাধান করেছিলেন৷ তারা বিশেষ এক কৌশলে এমআরএনএ এমনভাবে বদলে দিতে পেরেছিলেন, যাতে শরীর আর সেটির মোকাবিলা না করে৷ সঠিক প্রভাবের ভিত্তিতে সেই পরিবর্তন আনতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল৷ কারিকো বলেন, ‘‘একশোরও বেশি সম্ভাব্য রদবদল ছিল৷ আমরা ভেবেছিলাম, সেখানে হয়তো এক বা একাধিক কিছু থাকবে, যা ইমিউন সিস্টেমকে সক্রিয় করে তুলবে না৷ শরীর তা সত্ত্বেও অনেক প্রোটিন তৈরি করবে৷ আমরা এমন কিছুই খুঁজে পেয়েছিলাম৷''
সেটা ছিল যুগান্তকারী এক আবিষ্কার৷ ২০২০ সালে রেকর্ড সময়ের মধ্যে এমআরএনএ টিকা তৈরি সম্ভব করতে কয়েক দশকের গবেষণার প্রয়োজন হয়েছিল৷ দশ বছর আগে মহামারি দেখা দিলে এমআরএনএ টিকার কথা ভাবাই যেতো না৷
ভেরোনিকা সিমন/এসবি