চাকরি হারানো দুদক কর্মকর্তার প্রাণ বাঁচানোর আকুতি
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২টেলিফোনে তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘দুর্নীতিবাজরা আমাকে ছাড়বে না৷ আমি প্রাণভয়ে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছি৷ আমার পরিবার চরম আতঙ্কে আছে৷ আপনারা আমাকে বাঁচান৷’’
দুদকের পটুয়াখালীর উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিনকে দুদক বুধবার চাকরিচ্যুত করে৷ এর আগে তিনি চট্টগ্রামে ছিলেন৷ গত বছরের ১৬ জুন তাকে পটুয়াখালি বদলি করা হয়৷ জানা যায়, পটুয়াখালিতে গত ছয় মাস তাকে মামলার কোনো তদন্ত করতে দেয়া হয়নি৷ সেখানে দুর্নীতিবাজরা তার বাসায় গিয়ে তাকে প্রাণনাশের হুমকি ও চাকরিচ্যুতির ভয় দেখাতো বলেও তিনি অভিযোগ করেছেন৷
গত ৩০ জানুয়ারি তাকে সাত দিনের মধ্যে চাকরি খাওয়া ও প্রাণনাশের হুমকি দেয়ার কথা জানিয়ে তিনি থানায় জিডি করেন৷ বিষয়টি দুদদক মহাপরিচালককেও লিখিতভাবে জানান৷ কিন্তু কথিত হুমকির ১৬ দিনের মাথায় দুদক তাকে চাকরিচ্যুত করে৷
দুদক কর্মকর্তা মো. শরীফ উদ্দিনের দাবি অনুযায়ী, প্রধানত চারটি কারণে তিনি দুর্নীতিবাজদের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন:
১. কক্সবাজারে ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে দুর্নীতি ও জালিয়াতির তদন্ত করা৷ সেখানে প্রধানমন্ত্রীর ৭০-৭২ টি অগ্রাধিকার প্রকল্প চলমান৷ ওই প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে ১৫৫ জনকে আসামি করে মামলা করেছেন শরীফ উদ্দিন৷ সেখানে কীভাবে সরকারের টাকা লুটপাট হচ্ছে অভিযোগে তিনি তা তুলে ধরেছেন৷ ওই মামলায় সরকারি কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা, আইনজীবী, সাংবাদিক ও দালাল চক্রের সদস্যদের আসামি করা হয়েছে৷ এর মাধ্যমে ৫০ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে আনার চেষ্টা করেছেন তিনি৷
২. চট্টগ্রামের কর্ণফুলি গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির সাবেক এমডি আইউব খান চৌধুরীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত৷ এর আগে ১৪ বার অভিযুক্ত নথিভুক্ত করেছে দুদক৷ কিন্তু শরীফ উদ্দিন ১৫তম তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে অভিযোগ নথিভুক্ত না করে তদন্ত চালিয়ে গেছেন৷ আইউব খান চৌধুরীর দুর্নীতির ব্যাপারে প্রতিবেদন দিয়েছেন৷ নিজের আত্মীয়-স্বজনদের নিয়োগ, সংযোগ বাণিজ্য, গ্যাস চুরিসহ আরো দুর্নীতির তথ্য তিনি তুলে ধরা হয় সেখানে৷
৩. রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি পাসপোর্ট দেয়ার বাণিজ্য নিয়ে মামলা করা৷ এ বিষয়ে ২০টি মামলা করেছেন তিনি৷ এই পাসপোর্টের সঙ্গে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, সরকারি কর্মকর্তা ও দালাল চক্র জড়িত৷
৪. চট্টগ্রামে স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি নিয়ে তিনি তদন্ত করা৷ এই দুর্নীতির সাথে জড়িত একজন বড় রাজনৈতিক নেতা ও স্বাস্থ্যখাতের নেতার বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা করেছেন শরীফ উদ্দিন৷
যাদের কারণে চাকরিচ্যুতির অভিযাগ...
শরীফ উদ্দিন বলেন, ‘‘আইউব খান চৌধুরী এবং ওই রাজনৈতিক নেতা আমার বিরুদ্ধে সক্রিয়৷ আমাকে পটুয়াখালিতে বদলির পর তাদের লোকজন আমার বিরুদ্ধে নামে- বেনামে অভিযোগ দেয়া শুরু করে৷ চট্টগ্রামে সাড়ে তিন বছর চাকরির সময় আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ ছিল না৷ আমি পটুয়াখালি যাওয়ার পর আমার বিরুদ্ধে ৯৩ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ করে তারা৷ অথচ পটুয়াখালি যাওয়ার পর কোনো মামলার তদন্তই আমাকে দেয়া হয়নি৷’’
শরীফ উদ্দিন বলেন, ‘‘তাদের প্রভাবেই এখন আমাকে অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে৷ দুদকের যে ৫৪(২) ধারায় আমাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে তা বিতর্কিত এবং ওই আইন আদালতে চ্যালেঞ্জ হয়েছে, ওই আইনে কোনো তদন্ত বা নোটিস ছাড়াই চাকরিচ্যুত করার বিধান আছে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘আমি আমার প্রতিষ্ঠানের কাছে সুবিচার চাই৷ আমি এখন ভয়ে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছি৷ আমার পরিবারের সদস্যরাও আতঙ্কে আছে৷ দেশের জন্য কাজ করতে গিয়ে উল্টো আমি অপসারিত হয়েছি৷’’
কার পাশে দুদক?
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ মনে করেন, দুদক কর্মকর্তাকে অন্যায় ও বেআইনিভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে৷ তিনি বলেন, ‘‘দুদকের চাকরিচ্যুতির ৫৪(২) ধারাটি অসাংবিধানিক৷ কারণ, সেখানে কোনো তদন্ত বা কারণ দর্শানোর নোটিস ছাড়াই চাকরিচ্যুতির কথা বলা হয়েছে৷ এটা সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার ও বিচার পাওয়ার অধিকারের পরিপন্থি৷ এছাড়া এই ধারাটি চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে রিটও হয়েছে৷ তাই এই ধারাটির প্রয়োগ ঠিক হয়নি৷’’
তিনিও মনে করেন, ‘‘শরীফ উদ্দিন দুর্নীতিবাজদের রোষের শিকার হয়েছেন৷ দুদকের যেখানে দুর্নীতিবাজদের ধরার কথা, সেখানে তারা দুর্নীতিবাজদের পক্ষ নিয়েছে৷ তাই এখন প্রশ্ন উঠেছে দুদকের কাজ কি দুর্নীতিবাজদের ধরা, না রক্ষা করার?’’ তিনি রাষ্ট্র ও সরকারের কাছে এই কর্মকর্তাকে সুরক্ষা দেয়ার দাবিও জানান৷
শরীফ উদ্দিনের চাকরিচ্যুতির প্রসঙ্গে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘‘দুদকের এই কর্মকর্তা আইনের মধ্যে থেকে, যথাযথ প্রক্রিয়ায়, সাহসিকতার সাথে বড় বড় দুর্নীতির তদন্ত করছিলেন৷ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলে বড় বড় দুর্নীতি তিনি উন্মোচন করছিলেন৷ দুদকের দায়িত্ব ছিল এই তদন্তকাজে সহায়তা করা এবং তার পাশে দাঁড়ানো৷ তিনি দুর্নীতির সাথে জড়িত অনেক প্রভাবশালীরই বিরাগভাজন হয়েছেন৷ কিন্তু দুদক তার পাশে না দাঁড়িয়ে তাকে অপসারণ করেছে৷ দুদকের কাজ কি দুনীতি প্রতিরোধ করা, না যারা দুর্নীতি করে তাদের সুরক্ষা দেয়া?’’
আপনি সাফাই গাচ্ছেন, রাখেন!
তবে দুদকের আইনজীবী অ্যাডভোকেট খুরশিদ আলম বলেন, ‘‘দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিনকে আইন ও বিধি মেনেই অপসারণ করা হয়েছে৷ চাকরি হারানোর কারণে তিনি এখন নানা অভিযোগ করছেন৷ এটা সবাই করে৷’’
তার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘অনেক অভিযোগ৷ এত অভিযোগ যে এখন বলা যাবে না৷’’
দুই-একটি অভিযোগের উদাহরণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘ওই কর্মকর্তা আদালতের অনুমতি ছাড়া একজনের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করেছেন৷ সে আদালতের কাছে দুদককে বিব্রত করেছে৷ সে আইনের বাইরে গিয়ে কাজ করেছে৷’’
দুদক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ?
কিন্তু সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, তিনি তো দুর্নীতিবাজদের ধরতে সক্রিয় ছিলন- এ বিষয়টি মনে করিয়ে দিলে দুদকের আইনজীবী বলেন, ‘‘আপনি বললেই কেউ দুর্নীতিবাজ হয়ে যাবে? সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত প্রমাণ হওয়ার আগে কাউকে দুর্নীতিবাজ বলা যাবে না৷ সে কি পারে আদালতের অনুমতি ছাড়া একজনের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করতে? আর আপনি তার পক্ষে সাফাই গাইছেন৷ রাখেন!’’ এরপর দুদক আইনজীবী ফোন কেটে দেন৷
আর কর্ণফুলি গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির সাবেক এমডি আইউব খান চৌধুরীর বক্তব্য জানার জন্য তাকে বার বার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি৷
কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ
এদিকে দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিনকে অপসারণ করায় মাঝামাঝি পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি হয়েছে৷ বৃহস্পতিবার তারা ঢাকায় দুদক কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করেছেন৷ ঢাকার বাইরেও মানববন্ধন হয়েছে৷ শরীফ উদ্দিনকে চাকরিতে পুনর্বহাল ও চাকরিচ্যুতির বিতর্কিত ধারা বাতিলের দাবি জানিয়েছেন তারা৷