২০২৪ এর ভোট সফরে বেরিয়ে বিগত দুটি নির্বাচনের কথা বার বার মনে পড়ছে। ২০২১-এ পশ্চিমবঙ্গ আর ২০২২ সালে উত্তর প্রদেশ বিধানসভা নির্বাচন।
২০২২ সালে উত্তর প্রদেশের নির্বাচন কভার করতে যখন অযোধ্যা পৌঁছেছি, তখনো রামমন্দিরের কাজ চলছে। রাস্তা চওড়া করার জন্য একের পর এক বাড়ি ভাঙা হয়েছে। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় ঘেরা মন্দির চত্বরে মাথা উঁচিয়ে একের পর এক ক্রেন। সেই অযোধ্যার সঙ্গে ২০২৪ এর অযোধ্যার তফাত অনেক। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের কিছু কিছু মিল আছে।
২০২১-এর অযোধ্যায় মনে হয়েছিল, কোনো এক মন্ত্রবলে প্রাচীন ওই শহরের আকাশে কেউ যেন ধর্মের এক চাদর বিছিয়ে দিয়েছে। মন্দির, হিন্দুত্ব ছাড়া কেউ কোনো কথাই বলছে না। ২০২৪-এর নির্বাচনি সফরে বেরিয়ে আশ্চর্যজনকভাবে পশ্চিমবঙ্গের কোনো কোনো অঞ্চলে ধর্মের সেই চাদর দেখতে পাচ্ছি।
উত্তরবঙ্গের বালুরঘাটে ভোটের দিনের এক অভিজ্ঞতা মনে পড়ছে। উত্তরবঙ্গের শেষ প্রান্তের এই শহর বাংলাদেশের সীমান্তে অবস্থিত। সীমান্তের ভোট দেখতে বালুরঘাট শহর ছেড়ে আমরা যখন হিলি সীমান্তে পৌঁছেছি, তাপমাত্রা তখন ৪২ ডিগ্রি। সীমান্ত সুরক্ষা রক্ষীদের সঙ্গে কথা বলে একের পর এক সীমান্ত গ্রাম দেখছি। এমনই এক গ্রামে যাওয়ার জন্য বর্ডার চেকপোস্টে পৌঁছানোর পর জনৈক বললেন, যে গ্রামে যেতে চাইছি, সেখানে না গিয়ে অন্য একটি গ্রামে যাওয়া শ্রেয়। কারণ, ওই গ্রামের সংস্কৃতি ‘আমাদের' মতো নয়।
এই আমরা কারা? ‘ওদের'ই বা পরিচয় কী? ইদানীং সরাসরি সেই ভাগাভাগি করে ফেলছেন পশ্চিমবঙ্গের অনেকেই। মানুষের মুখে মুখে হিন্দু-মুসলমান। ১০ বছর আগেও প্রকাশ্যে যার কোনো অস্তিত্ব ছিল না এ বঙ্গে। মনে মনে নিশ্চয় ছিল, তা-ই রাজনীতির দেশলাই কাঠির স্ফূলিঙ্গে আজ তা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। ভোটের মঞ্চে দাঁড়িয়ে রাজনীতির কুশীলবেরা সরাসরি সাম্প্রদায়িক সুরসুরি দিচ্ছেন। ভোট ভাগ হচ্ছে ধর্মীয় ভোট ব্যাংকের অংকে। দুর্নীতি, কেলেঙ্কারিতে জর্জরিত পশ্চিমবঙ্গে শাসক দল তৃণমূলও এই মেরুকরণের রাজনীতিতে আশ্রয় নিয়েছে।
২০২২ সালের উত্তর প্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে ঠিক এই চিত্রই দেখেছিলাম আমরা। হিন্দু এবং মুসলিম মহল্লার সাম্প্রদায়িক বিভাজনের ছবি স্পষ্ট ধরা পড়েছিল। ২০২৪-এর উত্তর প্রদেশে সাম্প্রদায়িক বিভাজন নেই, এমনটা বলা যায় না। তবে এবারের ভোটে সেখানে তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবৃদ্ধি, জাতিগত ‘অভিমান'। দীর্ঘদিন ধরে উত্তর ভারতের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেছে এই জাত্যাভিমান। জাঠ-গুজ্জর-ঠাকুর-দলিতের আলাদা ভোট ব্যাংক। আশ্চর্যের বিষয়, খোদ অযোধ্যায় গিয়েও মনে হয়নি, এবারের ভোটে রামমন্দিরের বিশেষ কোনো প্রভাব আছে।
প্রভাব আছে ৩৭০ ধারার। বারাণসীর জ্ঞানব্যাপী মসজিদে পুজোর দাবি জানিয়ে যে ৪ জন নারী আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন, তার একজন একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলেছেন। বারাণসীর ভোটারদের নিয়ে তৈরি সেই গ্রুপে রামমন্দিরের কথা নেই, আছে কাশ্মীর থেকে ৩৭০ অনুচ্ছেদ তুলে নেয়ার প্রসঙ্গ। আছে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের প্রসঙ্গ।
৩৭০ অনুচ্ছেদের অবলুপ্তি নিয়ে সরব কাশ্মীরের রাজনীতিবিদেরা। তবে সাধারণ মানুষ ক্যামেরার সামনে মুখ খুলছেন না। কেবল একটি কথা জানিয়ে দিচ্ছেন তারা, ভোট দেবেন। শুনতে আশ্চর্য লাগলেও বাকি ভারতের মতো ভোট হয় না কাশ্মীরে। বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি বহু সময়েই ভোট বয়কটের ডাক দেয়। ভোটে সহিংসতার ঘটনা ঘটে। অধিকাংশ সময়েই ভোট শতাংশ বাকি ভারতের চেয়ে অন্তত ২০ ভাগ কম থাকে উপত্যকায়। সেই কাশ্মীরে এবার প্রায় সকলেই বলছেন ভোট দেবেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচার করছেন বিভিন্ন দলের নেতা-কর্মীরা। ৩৭০ অবলুপ্তির পর, জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যকে রাতারাতি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল বানিয়ে দেওয়ার পর এটাই সেখানে প্রথম ভোট। কাশ্মীর বলছে, এই সব কিছুর উত্তর দেওয়া হবে এবারের ভোটে।
কাশ্মীরের মতো চিত্র নয় মাওবাদী অধ্যুষিত ছত্তিশগড়ে। ২০২৩ সালের বিধানসভা নির্বাচনে মাওবাদী অঞ্চলের বেশ কিছু এলাকায় মানুষ ভোট দিলেও এবার ভোট শতাংশ আবার এক ধাপে অনেকটা নেমে গেছে। মানুষ বলছেন, "সেই যে ভোট পকেটে নিয়ে নেতারা গেলেন, আর তো এলেন না? জান বাজি রেখে ভোট দেওয়ার আর কী মানে রইলো তাহলে?”
সার্বিকভাবেই এবারে কম ভোট পড়ছে। কেন এমন হচ্ছে, তা নিয়ে নানা মুণির নানা মত। ভারতে যে কোনো বিষয়েই মত এবং মুণির সংখ্যা বেশি। ভারতে যে কোনো ভোটেই ইস্যুর সংখ্যা এক নয়, একাধিক। মণিপুর বা মিজোরাম যে দাবি নিয়ে ভোটের বুথে পৌঁছায়, পশ্চিমবঙ্গ বা কর্ণাটকের বিষয় তার চেয়ে আলাদা।
বিজেপি সরকারে আসার পর নানা ভাবে এই বহুত্ববাদ প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ‘ওয়ান ইন্ডিয়া' মডেলের কথা বলেছে হিন্দুত্ববাদীরা। গত ১০ বছরে তার প্রভাব কম-বেশি পড়েছে গোটা দেশেই। ২০১৯ সালের নির্বাচনে হিন্দুত্ববাদ এবং জাতীয়তাবাদ সার্বিকভাবে আলোড়িত করেছিল দেশের মানুষকে। ২০২৪-এ কিছুটা হলেও তা ফিকে। গাড়ির উইন্ড স্ক্রিন দিয়ে এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যের যে ছবি ভেসে উঠছে এক এক করে, সেখানে দৈনন্দিন সমস্যা ধর্মের চেয়ে অনেক বড় হয়ে উঠছে ক্রমশ।