1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

গণপিটুনির শিকড় বিচারহীনতায়

প্রভাষ আমিন
৯ ডিসেম্বর ২০২২

বাংলাদেশে সেবা খাত নিয়ে অনেক সমালোচনা আছে৷ তবে জরুরি সেবা নাম্বার ৯৯৯এর সেবা নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সমালোচনা পাওয়া যায়নি৷ বরং ৯৯৯এ ফোন করে সবাই সেবা পেয়েছেন৷

https://p.dw.com/p/4KhpN
গণপিটুনি কি আমাদের মনোজগতে ঠাঁই করে নিয়েছে?
গণপিটুনি কি আমাদের মনোজগতে ঠাঁই করে নিয়েছে?ছবি: Mohammad Saiful Islam/NurPhoto/picture alliance

বাংলাদেশের বিবেচনায় দারুণ ব্যতিক্রমী এক সেবা ৯৯৯৷ গত ২০ অক্টোবর ভোরে বরিশাল সদর উপজেলার চরকাউয়া ইউনিয়নের এআরখান বাজার থেকে একটি ফোন আসে ৯৯৯এ৷ পুলিশ গিয়ে বাজারের একটি দোকানের ভেতর থেকে ইয়াছিন খাঁ নামে একজনকে উদ্ধার করে৷ পরে অবশ্য পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে৷ ইয়াছিন খাঁ আসলে একজন পেশাদার চোর৷ ভোররাতে চুরি করতে তালা ভেঙে দোকানে ঢুকেছিলেন ইয়াছিন খাঁ৷ কিন্তু চুরির মালামাল গোছাতে গোছাতে সময় পেরিয়ে যায়৷ বেরোনোর সময় দেখেন ভোর হয়ে গেছে৷ আশপাশে মানুষ জড়ো হয়ে গেছে৷ তাই তিনি ৯৯৯এ ফোন করেন৷ পরে গ্রেপ্তার হলেও উপস্থিত বুদ্ধি ইয়াছিনকে গণপিটুনি থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে৷ ইয়াছিনের কাছ থেকেই হয়তো শিখেছেন চুয়াডাঙ্গার জীবননগরের সাইকেল চোর নয়ন সরকার৷ গত ১০ নভেম্বর তিনি ৯৯৯ এ ফোন করে জানান, কয়েকজন ব্যক্তি তার সাইকেল কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করছে৷ পুলিশ এসে দেখলো, ঘটনা উল্টো৷ সাইকেল চুরি করে পালানোর সময় ধরা পড়েন নয়ন৷ ইয়াছিন ও নয়ন দুই চোরই গণপিটুনির ভয়ে ৯৯৯এ ফোন করে পুলিশের সাহায্য চান৷ গণপিটুনির চেয়ে পুলিশকে তাদের কাছে নিরাপদ মনে হয়েছে৷

এমনিতে বাংলাদেশের মানুষ নরম, কোমল৷ কিন্তু গণপিটুনির মত একটা নিষ্ঠুর প্রক্রিয়া কীভাবে আমাদের রক্তে ঢুকে গেল, তা নিয়ে সমাজবিজ্ঞানীরা গবেষণা করতে পারেন৷ কিন্তু এটা অস্বীকার করার জো নেই, গণপিটুনি এখন আমাদের মনোজগতে ঠাঁই করে নিয়েছে৷ আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে ২০১১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত গণপিটুনিতে ৮০০ লোকের মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে৷ বাকি সময়ের হিসাব যোগ করলে সংখ্যাটা হাজার ছাড়িয়ে যাবে৷ যে কোনো বিবেচনায় ১১ বছরে গণপিটুনিতে এক হাজার মানুষের মৃত্যু আঁতকে ওঠার মত৷ একটি সভ্য সমাজে বিনা বিচারে হাজার মানুষের মৃত্যু কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়৷ আসলে হাজার নয়, গণপিটুনিতে একজন মানুষের মৃত্যুও গ্রহণযোগ্য নয়৷ প্রত্যেকটি মানুষের জীবন অমূল্য৷ বিজ্ঞান অনেক কিছু আবিষ্কার করেছে৷ কিন্তু একজন মানুষেরও জীবন দেয়ার ক্ষমতা কারো নেই৷ যে জীবন দেয়ার ক্ষমতা কারো নেই, সে জীবন কেড়ে নেয়ার ক্ষমতাও কারো থাকা উচিত নয়৷ তাই বিচারিক প্রক্রিয়ার বাইরে, কাউকে হত্যা করা অপরাধ৷ গণপিটুনিও একটি সম্মিলিত অপরাধ৷

গণপিটুনি নিয়ে কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের অসাধারণ একটি ছোটগল্প আছে৷ ‘চোখ' নামের সেই গল্পের শুরুটা হলো, ‘আজ বাদ-আছর খেজুর কাঁটা দিয়ে মতি মিয়ার চোখ তুলে ফেলা হবে৷' মতি মিয়া নামেএক চোরকে ধরে গণপিটুনি দিয়ে প্রায় থেতলে ফেলে বেধে রাখা হয়েছে বাদ আছর খেজুর কাঁটা দিয়ে চোখ তুলে ফেলা হবে বলে৷ চোখ তোলার ব্যাপারে অভিজ্ঞ ইদরিসকেও খবর দিয়ে আনা হয়েছে৷ একজনের মানুষের চোখ তোলার বিষয়টি রীতিমত উৎসবে রূপ নিয়েছে৷ সাধারণ মানুষ তো এসেছেনই; রিটায়ার্ড স্টেশনমাস্টার, হাইস্কুলের হেডমাস্টার সাহেবের মত বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও এসেছেন৷ হুমায়ূন আহমেদ তাঁর সেই ছোটগল্পেই গণপিটুনির কারণটা তুলে এনেছেন৷ মতি মিয়াকে ধরে আনার কৃতিত্ব হাসান আলীর৷ তার সাথে হেডমাস্টারের কথোপকথন, ‘‘হেডমাস্টার সাহেব বললেন, চউখ তোলা হইব কথাটা কি সত্য? ‘জ্বে সত্য৷ এইটা সকলের সিদ্ধান্ত৷ চউখ তুললেই জন্মের মতো অচল হইব৷ থানা-পুলিশ কইরা কোনো ফায়দা নাই৷' ‘অতি সত্য কথা, কোনো ফায়দা নাই৷ তবে থানাওয়ালা ঝামেলা করে কিনা এইটা বিবেচনায় রাখা দরকার৷' ‘আছে, সবই বিবেচনার মইধ্যে আছে৷ মেম্বর সাব থানাওয়ালার কাছে গেছে৷'' এই যে ‘থানা-পুলিশ কইরা কোনো ফায়দা নাই' আমাদের এই বদ্ধমূল ধারণাতেই প্রোথিত বিচারহীনতার সংস্কৃতি৷ আর এই বিচারহীনতা থেকেই আসে গণপিটুনি বা ক্রসফায়ারের মত বিচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের প্রয়োগ৷ গণপিটুনি আর ক্রসফায়ার- দুইটা একই ধরনের অপরাধ৷ গণপিটুনিতে সাধারণ মানুষ আইন হাতে তুলে নেয়৷ আর ক্রসফায়ারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আইন হাতে তুলে নেয়৷ কিন্তু আইনের শাসনে কারোই আইন হাতে তুলে নেয়ারঅধিকার নেই, কারো গায়ে হাত তোলার অধিকার কারো নেই৷ কিন্তু গণপিটুনি আর ত্রসফায়ার- এই দুই বিচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ডই বাংলাদেশে খুব জনপ্রিয় এবং দুই বিচারবহির্ভূত অপরাধেরও কোনো বিচার হয় না৷ গণপিটুনী আর ক্রসফায়ারের মত অপরাধ বন্ধ করতে হলে বিচার ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে৷ আর যে পশুত্ব আমাদের মানুষ হত্যায় আনন্দ দেয়, সেই পশুটা হত্যা করতে হবে৷

প্রভাষ আমিন, সাংবাদিক ও লেখক
প্রভাষ আমিন, সাংবাদিক ও লেখকছবি: DW/S. Hossain

গণপিটুনির পেছনে বিচারহীনতার সংস্কৃতি যেমন আছে, নিষ্ঠুর মনস্তত্ব আছে, আছে নানান স্বার্থও৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যাপক বিস্তৃতিতে গণপিটুনিরও বিস্তার ঘটেছে৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছড়ানো এবং কাউকে পিটিয়ে বা পুড়িয়ে মেরে ফেলা এখন ডালভাত৷ পরিকল্পিতভাবে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতেও গণপিটুনির ঘটনা ঘটানো হয়৷ পদ্মাসেতুতে মানুষের মাথা লাগবে, এমন গুজবে দেশজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়েছিল৷ সেসময় ছেলেধরা সন্দেহে অন্তত ৭ জনকে পিটিয়ে মারা হয়েছিল৷ খোদ রাজধানীতে গণপিটুনিতে তাসলিমা বেগম নামে নারীর মৃত্যু আলোড়ন তুলেছিল সারাদেশে৷ নোয়াখালীতে পুলিশের গাড়ি থেকে নামিয়ে এক তরুণকে পিটিয়ে মারার ঘটনাও কাঁদিয়েছিল সবাইকে৷ রাজধানীর আমিনবাজারে ডাকাত সন্দেহে ৬ ছাত্রকে পিটিয়ে মারার ঘটনায়ও তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছিল৷ কিন্তু বিচারহীনতায় যেমন গণপিটুনির শিকড়, তেমনি গণপিটুনিতে হত্যার ঘটনারও কোনো বিচার হয় না৷

গণপিটুনিতে ১১ বছরের হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু যেমন আমাদের আতঙ্কিত করে, তেমনি গণপিটুনির আতঙ্ক আরো অনেক মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়৷  সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সড়ক দুঘটনায় রুবিনা নামে এক নারীর মৃত্যুও কিন্তু সেই গণপিটুনির আতঙ্ক থেকেই উৎসারিত৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উল্টো দিকের রাস্তা ধরে দেবরের সাথে মোটর সাইকেলে হাজারীবাগে যাচ্ছিলেন রুবিনা৷ পেছন থেকে একটি গাড়ি তাদের মোটর সাইকেলকে ধাক্কা দেয়৷ চালক মোটর সাইকেলসহ বাম দিকে ছিটকে পড়েন৷ আর রুবিনা ডানদিকে ছিটকে পড়ে গাড়ির বাম্পারের  সাথে আটকে যান৷ আটকে যাওয়া রুবিনাকে নিয়েই গাড়ির চালক দ্রুতগতিতে পালাতে থাকেন৷ ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, আশপাশের মানুষ গাড়িটি থামানোর চেষ্টা করছেন, আর গাড়িটি বেপরোয়া গতিতে ছুটছে৷ টিএসসি হয়ে নীলক্ষেতের দিকে এক কিলোমিটারেরও বেশি পথ যাওয়ার পর জনতা গাড়িটি আটক করে৷ তখনও রুবিনা বেঁচেছিলেন৷ কিন্তু এক কিলোমিটারেরও বেশি গাড়ির সাথে ছেচড়ে যাওয়া রুবিনার রক্তে রঞ্জিত হয়েছে রাজপথ, তার শরীর থেকে মাংসের টুকরা পড়ে থাকে পথে পথে৷ শেষ পর্যন্ত হাসপাতালে নেয়ার পর রুবিনা মারা যান৷ গাড়ির চালক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক শিক্ষক আজহার জাফর শাহও গণপিটুনিতে আহত হন৷ পরে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে৷ ধাক্কা লাগার সাথে সাথে গাড়িটি থামানো হলে কারোই তেমন ক্ষতি হতো না, রুবিনাও বাঁচতে পারতেন৷ কিন্তু নিজের ক্যাম্পাসেও গাড়িটি থামানোর সাহস পাননি জাফর৷ তার নিশ্চয়ই ভয় ছিল, থামালেই গণপিটুনির শিকার হবেন৷ শেষ পর্যন্ত তিনি গণপিটুনি থেকে বাঁচতে পারেননি, তবে ততক্ষণে ঝড়ে গেছে একটি প্রাণ৷ শুধু রুবিনা নন, চালকের গণপিটুনির ভয়ে এমন আরো অনেককে প্রাণ দিতে হয়৷ অনেক সময়ই দুর্ঘটনার প্রথমে সামান্য ধাক্কা লাগে৷ তাৎক্ষণিকভাবে গাড়িটি থামলে হয়তো সামান্য আহত হয়ে মানুষটি বেঁচে যেতে পারতেন৷ কিন্তু আতঙ্কিত চালক গণপিটুনি থেকে বাঁচতে সেই মানুষটির ওপর দিয়েই গাড়িটি চালিয়ে দেন৷ তাতে তাৎক্ষণিকভাবে মানুষটি মারা যান৷ এখন আমি বড় বড় কথা লিখছি বটে- জাফরের উচিত ছিল গাড়িটি থামানো, রুবিনাকে হগাসপাতালে নিয়ে যাওয়া৷ কিন্তু গাড়িটিতে আমি বা আপনি থাকলে কী করতাম? আত্মরক্ষার স্বাভাবিক রিফ্লেক্সে আমরাও হয়তো পালাতেই চাইতাম৷

‘থানা-পুলিশ কইরা কোনো ফায়দা নাই' এই ধারণা যতদিন আমাদের মাথা থেকে না যাবে, যতদিন আমরা পরিপূর্ণ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে না পারবো, মানুষকে মারতে পারা যতদিন আমাদের হাতের সুখ হবে; ততদিন নির্দোষ মানুষ গণপিটুনিতে মরতেই থাকবে৷ গণপিটুনির ভয়ে না থামানো গাড়ির নিচে চাপা পড়ে মারা যাবে আরো অনেকে৷ গণপিটুনির শিকার বা গণপিটুনির ভয়ে পলায়নপর গাড়ির নিচে চাপা পড়ে যে কোনো দিন, আমি-আপনি যে কেউ মারা যেতে পারি৷

পুলিশ হোক আর সাধারণ মানুষ, আইন হাতে তুলে নিলেও বিচার হবে না, মানুষ মারা যতদিন উৎসবের বিষয় থাকবে; আর যাই হোক, ততদিন আমরা নিজেদের অন্তত সভ্য দাবি করতে পারবো না৷