কেমন আছে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো
ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে আছে বেশ কিছু ঐতিহাসিক স্থাপনা৷ তবে বেশিরভাগ স্থাপনাই যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে৷ আর যেগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে, সেগুলো নিয়েও আছে বিস্তর অভিযোগ৷
রূপলাল হাউস
ঊনিশ শতকের গোড়ার দিকে বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে তৈরি হওয়া সুরম্য এই অট্টালিকাটি এখন খুঁজে পাওয়াই কষ্টকর৷ পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীদের দখলে যাবার পর রূপলাল হাউস ধ্বংসের গোড়ায় পৌঁছেছে৷ ফরাশগঞ্জের স্বরূপ চন্দ্রের দুই পুত্র রূপলাল দাস এবং রঘুনাথ দাস ১৮৪০ সালে এক আর্মেনীয় ব্যবসায়ীর কাছ থেকে পুরোনো একটি ভবন কেনেন৷ পরে কলকাতার স্থপতি নিয়োগ করে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে রূপলাল হাউসের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেন তাঁরা৷
আহসান মঞ্জিল
পুরান ঢাকার আরেক ঐতিহাসিক স্থাপনা আহসান মঞ্জিলকে এখন বুড়িগঙ্গা থেকে দেখাই যায় না৷ এর সামনে বসে ফলের বাজার৷ সম্মুখভাগে তাই টিনের বেড়া দিয়ে দেয়া হয়েছে৷ ১৮৩০ সালে ঢাকার নবাব খাজা আলিমুল্লাহ ফরাসিদের কাছে থেকে পুরনো একটি ভবন কিনে নেন৷ ১৮৭২ সালে নবাব আব্দুল গণি এটিকে নতুন করে নির্মাণ করে তাঁর ছেলে খাজা আহসান উল্লাহর নামে এর নামকরণ করেন৷
বড় কাটরা
পুরান ঢাকার চকবাজারে মুঘল আমলের গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থাপনাও সংরক্ষণের অভাবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে৷ সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজার নির্দেশে ১৬৪১ খ্রিষ্টাব্দে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে এই ইমারতটি নির্মাণ করা হয়৷ বর্তমানে একটি মাদ্রাসা হয়েছে৷ বেশ কিছু ব্যবসায়ী এ ভবনটি দখল করে আছে৷ স্থাপত্য সৌন্দর্যের বিবেচনায় একসময়ে বড় কাটরার সুনাম থাকলেও বর্তমানে এর ফটকটি যেন ভগ্নাবশেষ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে৷
ছোট কাটরা
ঢাকার চকবাজারে বড় কাটরার কাছেই আরেক ঐতিহাসিক স্থাপনা ছোট কাটারা৷ শায়েস্তা খানের আমলে আনুমানিক ১৬৬৩ থেকে ১৬৬৪ সালের দিকে এই ইমারতটির নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং তা শেষ হয় ১৬৭১ সালে৷ দেখতে অনেকটা বড় কাটরার মতো হলেও এটি আকৃতিতে বড় কাটরার চেয়ে ছোট এবং এ কারণেই হয়তো এর নাম হয়েছিল ছোট কাটরা৷ সংরক্ষণের অভাবে বর্তমানে মুঘল আমলের এ স্থাপনাটিও ধ্বংসপ্রায়৷
হাজী শাহবাজ মসজিদ
ঢাকার রমনা এলাকায় হাইকোর্টের পিছনে হাজী শাহবাজ মসজিদ সরকার ঘোষিত সংরক্ষিত পুরাকীর্তি৷ কিন্তু এর পেছনের অংশে আলাদা লোহার ফ্রেম বসানো হয়েছে ছাউনি দেওয়ার জন্য৷ যার ফলে স্থাপনাটির সৌন্দর্য হানি হয়েছে৷ মুঘল শাসনামলে শাহজাদা আযমের সময়কালে ১৬৭৯ খ্রিষ্টাব্দে এ মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন কাশ্মীর থেকে বাংলায় আসা ধনাঢ্য ব্যবসায়ী হাজী শাহবাজ৷
গোয়ালদী শাহী মসজিদ
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে গোয়ালদী শাহী মসজিদের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণার পিলারটি ভবন থেকে খেসে পড়ার উপক্রম হলেও দীর্ঘ দিন চোখ পড়েনি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের৷ সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহের আমলে মোল্লা হিজাবর খান ১৫১৯ খ্রিষ্টাব্দে নির্মাণ করেছিলেন এক গম্বুজ বিশিষ্ট এ মসজিদটি৷
পানাম নগর
নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁওয়ে অবস্থিত প্রাচীন বাংলার রাজধানী ঐতিহাসিক পানাম নগর৷ ১৫ শতকে ঈসা খাঁ বাংলার প্রথম রাজধানী স্থাপন করেছিলেন এই সোনারগাঁওয়ে৷ প্রায় ৫ মিটার চওড়া এবং ৬০০ মিটার দীর্ঘ একটি সড়কের দু’পাশে সুরম্য ৫২টি বাড়ি প্রাচীন এই নগরের অন্যতম আকর্ষণ৷ কিন্তু সঠিক সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ না করায় ঐতিহাসিক এ শহরটি ধ্বংস হতে চলছে৷
ষাট গম্বুজের মসজিদ
ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য স্থাপনা বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদের অভ্যন্তরের পাথরের তৈরি পিলারগুলো ১৯৯৮ থেকে ২০০২ সালের এক সংস্কার কাজের সময় সুরক্ষার কথা বলে পলেস্তারার প্রলেপে ঢেকে দেয়া হয়েছিল৷ তবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের বোধোদয় হওয়ায় সাম্প্রতিক সংস্কারের সময়ে পিলারগুলোর পাথরের উপর থেকে পলেস্তারা তুলে ফেলা হয়েছে৷
অযোধ্যার মঠ
বাগেরহাটের যাত্রাপুরে সরকার ঘোষিত সংরক্ষিত পুরাকীর্তি ‘অযোধ্যার মঠ’ কিংবা ‘কোদলা মঠ’৷ মঠের গায়ে গজিয়ে ওঠা বড় বড় পরগাছাগুলোই সংরক্ষিত এ পুরাকীর্তিটির প্রতি সরকারের অবহেলার বড় প্রমাণ৷
চুনাখোলা মসজিদ
বাগেরহাটের বিশ্ব ঐতিহ্য স্থাপনার অংশ চুনাখোলা মসজিদের দেয়ালের ইট খসে পড়ার উপক্রম, দরজা-জানালার গ্রিলও মরিচা ধরে খুলে পড়েছে৷ দীর্ঘদিন সংরক্ষণের ছোঁয়া লাগেনি প্রাচীন এ স্থাপনাটিতে৷
গোকুল মেধ
বগুড়ার মহাস্থানগড়ের কাছে ঐতিহাসিক ‘গোকুল মেধ’৷ বেহুলার বাসরঘর নামেও এটি পরিচিত৷ বাতি ঝুলানোর জন্য ঐতিহাসিক এ প্রত্নস্থলটির চারপাশ ঘেঁষে বাঁশ বসানো হয়েছে৷
বড় বাড়ি
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার হরিপুর গ্রামে তিতাস নদীর তীরে জমিদার কৃষ্ণপ্রসাদ রায় চৌধুরীর সুরম্য প্রাসাদ বড়বাড়িতেও সংস্কারের হাত পড়েনি কখনো৷ ফলে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় এ বাড়িটি দখল করে আছে ৪০টিরও বেশি পরিবার৷
চার আনি জমিদার বাড়ি
কোনো রকম সংরক্ষণ না করায় প্রায় ধ্বংসই হয়ে গেছে নাটোরের পুঠিয়ার চার আনি জমিদার বাড়ি৷ পুঠিয়া রাজবাড়ীর শ্যাম সরোবরের দক্ষিণ পাশের এ চার আনি জমিদার বাড়ি ছাড়াও চার আনি কাছারি বাড়িও ধ্বংসের শেষ প্রান্তে৷
বড় সর্দার বাড়ি
ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর ধ্বংসের মহোৎসবের মাঝেও দু-একটি স্থাপনা খুব ভালোভাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে৷ যেমন ধুরণ সোনারগাঁওয়ের ঐতিহাসিক বড় সর্দার বাড়ি৷ অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে এ বাড়িটি সংস্কার করে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে৷ কোরীয় বহুজাতিক কোম্পানি ইয়ংওয়ান কর্পোরেশনের প্রায় দুই মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সহায়তায় করা হয়েছে এ সংস্কার কাজ৷
এবং প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সাইনবোর্ড
বাংলাদেশের যে কোনো সংরক্ষিত পুরাকীর্তি যারা দেখেছেন, এই সাইনবোর্ডটি তাঁদের কাছে বেশ পরিচিত৷ মূল্যবান এই পুরাকীর্তিটি নষ্ট বা ধ্বংস করলে কী শাস্তি হতে পারে তা লিপিবদ্ধ আছে এখানে৷ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এ সাইনবোর্ডটি বসিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ করেছে৷ প্রতিটি স্থাপনাতেই সংরক্ষণে অবহেলার ছাপ চোখে পড়ে সহজেই৷