কলকাতায় হুমকির বিরুদ্ধে ‘জিহাদ'
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ভারতীয় রাজনীতির সৌজন্যে ‘লাভ জিহাদ' শব্দবন্ধটি অনেক দিন ধরেই শোনা যাচ্ছে৷ এ নিয়ে তর্ক-বিতর্কও কম হচ্ছে না৷ কিন্তু, ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী কলকাতাকে কখনও লাভ জিহাদের প্রচার ঘিরে আতঙ্কে পড়তে হয়নি৷ বিক্ষিপ্ত ঘটনা সামনে এসেছে বটে, তবে তাতে খুব একটা হইচই হয়নি৷ এবার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ ভিন্ন ধর্মের একঝাঁক যুগলের তালিকা প্রকাশ করে খুনের হুমকি দেওয়ায় বিষয়টি নিয়ে আলোড়ন পড়েছে৷ সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত ৬৮টি দম্পতির সেই তালিকা নিয়ে অভিযোগ জমা পড়েছে কলকাতা পুলিশের কাছে৷
জানুয়ারি মাস থেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘোরাফেরা করছে তালিকাটি— সেখানে যে দম্পতিদের নাম রয়েছে, তাঁদের ক্ষেত্রে স্বামী ধর্মপরিচয়ে মুসলমান ও স্ত্রী হিন্দু৷ পাত্রী ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন৷ নিয়েছেন নতুন নাম৷ একে কেন লাভ জিহাদ বলা হচ্ছে? কী-ই বা অর্থ এই কথাটার? এই শব্দবন্ধে ভালোবাসার সঙ্গে জিহাদ, অর্থাৎ ধর্মের জন্য সংগ্রামকে সুকৌশলে জুড়ে দেওয়া হয়েছে৷ কট্টরপন্থি হিন্দু সংগঠনগুলির ব্যাখ্যা অনুযায়ী, মুসলমান যুবকরা প্রেমের ফাঁদে বন্দি করছে হিন্দু মেয়েদের৷ এটা নিছকই প্রেম নয়, প্রেমের কৌশল৷ আসল উদ্দেশ্য হিন্দু মহিলাদের ধর্মান্তরিত করে তাঁদের ইসলামের পক্ষে লড়াইয়ে নামিয়ে দেওয়া৷ ফেসবুক ও টুইটারে ভাইরাল হয়ে যাওয়া তালিকাটিতে যে ৬৮টি যুগলের নাম রয়েছে, তাঁদের মধ্যে সব মুসলমান যুবককেই ষড়যন্ত্রী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে৷ ‘হিন্দু বার্তা' নামে ফেসবুক গ্রুপের পক্ষ থেকে প্রোফাইলের তালিকা প্রকাশ করে বলা হয়, ‘‘এই সূচিতে থাকা হিন্দু মেয়েরা লাভ জিহাদের শিকার হয়েছে বা হতে যাচ্ছে৷ সব হিন্দু সিংহের কাছে আর্জি, এই মহিলাদের সঙ্গে যাদের সম্পর্ক রয়েছে, তাদের খুঁজে বের করে শিকার করুন!''
এই প্রোফাইল তালিকায় যে মহিলাদের নাম রয়েছে, এমন ফেসবুক পোস্টের পর তাঁদের আতঙ্কিত হওয়াই স্বাভাবিক৷ ‘মিলনমেলা' নামের আর একটি ফেসবুক গ্রুপের পক্ষ থেকে বিপ্লব চট্টোপাধ্যায় একই ধরনের পোস্ট করেছেন৷ নিজেকে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সদস্য বলে দাবি করে বিপ্লবের আহ্বান, ‘‘হিন্দু মেয়েদের ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হচ্ছে লাভ জিহাদের উদ্দেশ্যে৷ হিন্দুরা জেগে উঠুন, নইলে হোমল্যান্ড ভারতকে হারাতে হবে৷'' এ ধরনের বার্তা ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই দম্পতি বা যুগলদের কাছে হুমকি আসতে শুরু করেছে৷ সোশ্যাল মিডিয়াতেও শুরু হয়েছে হেনস্থা৷ এমনই এক দম্পতি কলকাতা পুলিশের সাইবার অপরাধ বিভাগে অভিযোগ করেছেন৷ ব্যক্তিগতভাবে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করার পাশাপাশি তাঁরা ধর্মের নামে ঘৃণা ছড়ানোর অভিযোগও তুলেছেন৷
দম্পতির এই অভিযোগের সূত্রে ভারতীয় সমাজ-রাজনীতির বৃহত্তর সমস্যাটা উঠে আসছে৷ অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, সব সম্পর্কের গায়ে কি এভাবে চক্রান্তের তকমা সেঁটে দেওয়া যায়? এটা কি নারী-পুরুষের সম্পর্ক ও ভালোবাসা, যা ধর্ম-বর্ণ-জাতিভেদের ঊর্ধ্বে, তার প্রতি অসম্মান নয়? যেখানে এমন নমুনা মিলছে যে, লাভ জিহাদের অভিযোগ ওঠার পর হিন্দু মহিলাটিই বলে উঠছেন, তিনি স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্মাবলম্বীকে বিয়ে করেছেন৷ সম্প্রতি ভারতে যে বিতর্কটি সবচেয়ে জোরালো, তার কেন্দ্রে কেরালার তরুণী অখিলা, যিনি বিয়ের পর হয়েছিলেন হাদিয়া৷ তাঁর স্বামী সাফিন জাহানের বিরুদ্ধে লাভ জিহাদের অভিযোগ উঠেছিল৷ অখিলার বাবা মামলা করেছিলেন৷ কিন্তু, আদালতে দাঁড়িয়ে হাদিয়া বলেছেন, তিনি স্বেচ্ছায় সাফিনকে বিয়ে করেছেন৷ এই ঘটনা প্রমাণ করে, সব সম্পর্কের পিছনে চক্রান্ত খুঁজতে যাওয়ার অর্থ নেই৷ আদতে সেটাই একটা রাজনৈতিক কৌশল৷
সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত লাভ জিহাদ ঘিরে দুই শিবির যুযুধান৷ ‘বাংলা পক্ষ' নামে একটি সংগঠন লাভ জিহাদের হুমকির প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছে৷ সেই সংগঠনের কর্তা গর্গ চট্টোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘গো বলয়ের সংস্কৃতি এখানে আমদানি করার চেষ্টা চলছে৷ এটা যে বড় আকারের ষড়যন্ত্র তাতে কোনও সন্দেহ নেই৷ বড় মদত না থাকলে সংগঠিতভাবে প্রচার চালানো সম্ভব হতো না৷ তবে এটা চেষ্টা মাত্র, এখানে এটা সফল হবে না৷''
বাংলার সংস্কৃতি তথা নাট্য জগতের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ও চিত্রাভিনেতা কৌশিক সেন লাভ জিহাদের তত্ত্ব খারিজ করেছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘যে কোনও মুসলিম ছেলের হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করা মানেই ফুঁসলিয়ে নিয়ে যাওয়া, এই দাবিটা ঠিক না৷ লাভ জিহাদের পক্ষে বা বিপক্ষে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই৷ আমার মনে হয়, এটা নিয়ে একটা স্বার্থসিদ্ধির খেলা চলছে৷''
তবে লাভ জিহাদনিয়ে হিন্দুত্ববাদী সংগঠন তাদের বক্তব্যে অনড়৷ হিন্দু সংহতির নেতা তপন ঘোষের মন্তব্য, ‘‘সমাজ ও ধর্মীয় সংগঠন থেকে মদত পেয়ে মুসলিমরা হিন্দু মেয়েদের ফুঁসলিয়ে বিয়ে করছে৷ এটা পুরোটাই পরিকল্পনামাফিক৷ বিয়ের আগে শারীরিক সম্পর্কের ছবি মোবাইলে তুলে জোর করেও বিয়ে করছে ওরা৷ অনেক সময় মেয়েদের বিক্রিও করে দিচ্ছে৷ এই সমস্ত কাজের জন্য বিপুলভাবে মোটিভেট করা হচ্ছে মুসলিম যুবকদের৷ তাদের বিপথে চালিত করা হচ্ছে৷ আমরা এটা আটকানোর চেষ্টা করছি৷ নাবালিকাদের সঙ্গে এমনটা ঘটলে পুলিশের সাহায্য নিচ্ছি৷''
এ প্রসঙ্গে কৌশিক সেনের মত, ‘‘আমাদের দেশে মানুষের জন্য খাদ্য, পানীয়, চিকিৎসা, শিক্ষার ব্যবস্থা কী হবে, তা নিয়ে আলোচনা বা আন্দোলন করাটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ৷ তার বদলে যারা লাভ জিহাদ নিয়ে আলোচনা করছেন, তারা মানুষের বৃহত্তর স্বার্থ থেকে নজর ঘুরিয়ে দিতে চাইছে৷ ধর্মান্তরিত করার সন্দেহে এটাকে ব্যবহার করছে কিছু মানুষ৷''
ভালোবাসার মাসে প্রেমকে এভাবে আক্রান্ত হতে দেখে কী অনুভূতি? কৌশিক সেন বলেন, ‘‘ভ্যালেন্টাইনস ডে নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই৷ ওটা স্রেফ বাণিজ্য৷ তবে আমি পছন্দ করি না বলে যারা ভ্যালেন্টাইনস ডে পালন করছেন, তাদের উপর চড়াও হবো না নিশ্চয়ই৷ অন্যের পছন্দ-অপছন্দ, ভালোবাসা নিয়ে বলার অধিকার কতখানি, এটা কে ঠিক করে দেবে?''