করোনা নিয়ে গুজব রটনাকারীদের শাস্তির দাবি
১৩ মার্চ ২০২০এক মাওলানা ওয়াজের সময় করোনাকে বলেছেন ‘আল্লাহর সোলজার (সৈনিক)'৷ আর তিনি হলেন সুপরিচিত ওয়াজেরিন মাওলানা কাজী ইব্রাহীম৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ওই ওয়াজে তিনি করোনা নিয়ে এক যুবকের স্বপ্নের কথা বলছেন৷ আর তাতে করোনা নাকি ওই যুবককে স্বপ্নে তিনটি নির্দেশনা দিয়েছে৷ সেই কথিত নির্দেশগুলো হলো: বাংলাদেশের মুসলমানরা যেন ভারতীয় টিভি-সিনেমা না দেখে৷ মসজিদকে যেন করা হয় পার্লামেন্ট৷ আর মসজিদ কমিটির সভাপতি হতে হবে মসজিদের ইমামকে, অথবা যার দাড়ি এক মুঠের চেয়ে লম্বা, তাকে৷ এই তিনটি শর্ত পূরণ হলে নাকি করোনা বাংলাদেশে আক্রমন করবে না৷
তিনি আরো বলেন, ‘‘করোনা হলো আল্লাহর সোলজার৷ তারা আসার পর দলে দলে মানুষ ইসলামমুখী হচ্ছে৷ তারা আসলে বাংলাদেশে তেমন আক্রমন করবে না বলে জানিয়েছে৷ কারণ, বাংলাদেশে ইসলাম নিয়ে সবচেয়ে বেশি কথা হয়৷''
আরো দুইজন ইসলামী বক্তা করোনা নিয়ে বয়ান দিয়েছেন৷ তারা হলেন মাওলানা সিফাত হাসান ও ইয়াহিয়া তাকি৷ তারা দু'জনই করোনাকে চীনাদের জন্য আল্লাহর পাঠানো ‘গজব' হিসেবে অভিহিত করেছেন৷
উইগুর মুসলানদের ওপর নির্যাতন ও কোরানের অবমাননা করায় চীনে ‘করোনা গজব' পাঠানো হয়েছে বলেও তারা বয়ান করেন৷ মাওলানা তাকি বলেন, ‘‘চীন পারে নাই৷ বাংলাদেশ সরকার কোনোভাবেই কোনো প্রস্তুতি নিয়ে করোনা ভাইরাস প্রতিহত করতে পারবে না৷ একমাত্র পথ তওবা করা৷'' আর মাওলানা সিফাত হাসান বলেন, ‘‘বাংলাদেশের সরকার যতই প্রস্তুতি নিক, ডাক্তার আর সচেতনতা দিয়ে এই আজাব, গজব থেকে বাঁচা যাবে না৷ আমাদের বলেল্লাপনা বন্ধ করতে হবে৷''
অবশ্য কথা বলার জন্য এই মাওলানাদের কাউকেই ফোনে পাওয়া যায়নি৷
এদিকে করোনা থেকে বাঁচতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন দোয়াও প্রচার করা হচ্ছে৷ এমনকি ধর্মমন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেনও একটি দোয়া তার ফেসবুকে দিয়ে আবার ইনবক্সও করছেন৷ একটি জীবন বাঁচাতে সবাইকে তা শেয়ার করার অনুরোধ করছেন৷
মেডিসিনের অধ্যাপক এবং প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘‘দোয়া পড়েন তাতে অসুবিধা নেই৷ তবে করোনা প্রতিরোধে চিকিৎসকদের দেয়া পরামর্শ এবং সতর্কতা মেনে চলুন৷ আর যারা গজব বা স্বপ্নের কথা বলছেন, তারা তাদের মনগড়া কথা বলছেন৷ তাহলে তো সৌদি আরব, ইরানের লোক আক্রান্ত হতো না৷ মুসলমানদের করোনা ভাইরাস আক্রমন করতো না৷ এইসব গাঁজাখুরি বক্তব্যের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবন্থা নেয়া দরকার৷''
এ প্রসঙ্গে সুপ্রিমকোকোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, এই ধরনের ধর্মীয় এবং অন্যান্য অপপ্রচার ও গুজব সরকারের কঠোর নজরদারিতে নেয়া উচিত৷ বিভ্রান্তকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন৷ এরজন্য প্রয়োজনীয় আইন আছে৷''
কোয়ারেন্টাইন এড়ালে শাস্তি
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে সর্বোচ্চ সতর্কতার অংশ হিসেবে বাংলাদেশে বিদেশ থেকে আসা সব যাত্রীর কোয়ারেন্টাইন বাধ্যতামূলক করেছে৷ সবাইকে সেল্ফ কেয়ারেন্টাইনে থাকতে বলেছে৷ এটা অমান্য করলে সংক্রামক ব্যাধি আইনে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে৷ এই আইনে দুই মাসের কারাদণ্ড এবং ২৫ হাজার টাকা জরিমানা, অথবা উভয় দণ্ডের বিধান আছে৷
কিন্তু এখন পর্যন্ত দেশের ২২ জেলায় এক হাজারের কিছু বেশি বিদেশ ফেরতকে সেল্ফ কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে, যা বিদেশফেরত যাত্রীদের তুলনায় খুবই কম৷ অনেকেই সেল্ফ কোয়ারেন্টাইন এড়িয়ে চলছেন বা তথ্য গোপন করে প্রকাশ্যে চলাফেরা করছেন৷ ডা. এম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘‘এটা ভয়াবহ পারিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে৷ করোনার বিস্তৃতি ঠেকাতে শতভাগ কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে হবে৷ কারণ, করোনা ভাইরাস সংক্রমণের লক্ষণ প্রকাশ পেতে সর্বোচ্চ ১৪ দিন লাগে৷ বাইরের দেশ থেকে এলে এই ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে থাকতেই হবে৷ এর মধ্যে লক্ষণ প্রকাশ না পেলে ভালো৷ আর প্রকাশ পেলে জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ( আইইডিসিআর)-এ যোগাযোগ করে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে হবে৷''
তিনি বলেন, ‘‘যারা এটা চাপিয়ে রেখেছে, গোপন করেছে তারাই বিপদে পড়েছে৷ এটা শুধু নিজের জন্য নয়, তার পরিবার ও দেশের মানুষকে নিরাপদ রাখার জন্য জরুরি৷''
আর এটা কার্যকর করার জন্য ঢাকাসহ জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রশাসনের মাধ্যমে কঠোর মনিটরিং করা দরকার বলে মনে করেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ৷ তিনি বলেন, ‘‘শতভাগ কোয়রেন্টাইন নিশ্চিত করতে শুধু প্রচলিত আইন নয়, প্রয়োজন হলে রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশও জারি করতে পারেন৷'' তার মতে , ‘‘আমাদের শিথিলতা দেখানোর কোনো সুযোগ নাই৷''
সর্বশেষ পরিস্থিতি
এদিকে শুক্রবার আইইডিসিআর-এর ব্রিফিংয়ে জানানো হয়েছে করোনা আক্রান্ত তিন জনের একজন পুরোপুরি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন৷ একজন সুস্থ হলেও এখনো হাসপাতালে আছেন৷ তৃতীয়জন এখনো করোনামুক্ত নয়৷ এর বাইরে চারজন নিবিড় কোয়ারেন্টাইনে আছেন৷ গত ২৪ ঘণ্টায় করোনার ২৪টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে৷ এখন পর্যন্ত মোট নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে মোট ১৮৭ জনের৷ নতুন করে কারো শরীরে কারোনার উপস্থিতি পাওয়া যায়নি৷ নতুন করে কোনো রোগীও নেই৷