পুরনো চাল ভাতে বাড়ে
১০ মার্চ ২০১৫ইয়ুংকারের অফিসে কি ইউরোপের ইতিহাস সংক্রান্ত কোনো কেতাব নেই? যদি থাকে, তাহলে তাঁর ইউরোপিয়ান ডিফেন্স কমিউনিটি বা ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা সমাজ সম্বন্ধীয় অধ্যায়টি একবার পড়ে দেখা দরকার৷ ৬০ বছরের বেশি আগের এক অসাফল্যের কাহিনি, বর্তমানের সঙ্গে যার বেশ কিছু মিল আছে৷
পরিকল্পনাটি জন্ম নিয়েছিল এক সংকটের কারণে: ১৯৫০ সালের জুলাই মাসে উত্তর কোরিয়া চীনের সাহায্য নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়াকে আক্রমণ করে, সেখানে কমিউনিস্ট শাসন চালু করার উদ্দেশ্যে৷ ইউরোপেও সেরকম কিছু ঘটতে পারে, এই আশঙ্কা থেকে ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা সমাজের বৈপ্লবিক ধারণাটি জন্ম নেয়: ফ্রান্স, ইটালি, বেনেলুক্স দেশগুলি এবং পশ্চিম জার্মানির সামরিক বাহিনীকে জাতীয় কর্তৃত্ব থেকে সরিয়ে নিয়ে একটি যৌথ, আধিজাতিক অধিনায়কমণ্ডলীর তাঁবে রাখা হবে৷ লক্ষ্য ছিল: সবাই মিলে আমরা শক্তিশালী, অপরদিকে কোনো একক দেশ যেন মাত্রাধিক শক্তিশালী না হয়ে ওঠে৷ নাৎসি আমলের মাত্র কয়েক বছর পরে জার্মানি সম্পর্কে বাকি ইউরোপের দ্বিধা তখনো কেটে ওঠেনি৷
সার্বভৌমত্ব পরিত্যাগ করতে অনীহা
মাত্র চার বছরের মধ্যে পরিকল্পনা তৈরি, তবুও তা শেষমেষ ব্যর্থ হয় – তৎকালীন সদস্য দেশগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী দেশ ফ্রান্সের জাতীয় সংসদে৷ কেননা ফ্রান্স এক ধাক্কায় অতটা সার্বভৌমত্ব পরিত্যাগ করতে রাজি ছিল না৷ কোরিয়া যুদ্ধের বিভীষিকাও ১৯৫৪ সালের মধ্যে ম্লান হয়ে এসেছিল৷
কাজেই এই সহজ প্রশ্নটা করা যেতে পারে: ১৯৫৪ সালের প্যারিস আর ২০১৫ সালের প্যারিসের মধ্যে কোনো ফারাক আছে কি? যথা: ফ্রান্স আফ্রিকায় তার নানা ধরনের সামরিক অভিযান চালিয়ে যাবে কী করে, যদি প্রতিক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে সে'বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয়? ফ্রান্সের তাতে রাজি হবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না৷ অর্থাৎ ইয়ুংকারের প্রস্তাব গোড়াতেই ঠিক সেখানে ঠোক্কর খাচ্ছে, অতীতেও যেখানে খেয়েছিল৷
জার্মান সৈন্যদের অভিযানে পাঠাবে কে?
আবার শুধু ফ্রান্সই তো নয়৷ ইইউ-র সব জাতীয় সংসদের মধ্যে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ অনুমোদন করার ব্যাপারে জার্মান সংসদের ক্ষমতাই সবচেয়ে বেশি৷ জার্মান সাংসদরা তাঁদের এই অধিকার বিনা বাক্যব্যয়ে ইইউ-র কোনো প্রতিষ্ঠান – তা সে ইউরোপীয় সংসদই হোক আর ইউরোপীয় কমিশনই হোক – তার হাতে তুলে দেবে, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য?
না, ইয়ুংকারের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য, কেননা তাঁর অপর যুক্তিও – সোজা কথায় – ভ্রান্ত৷ ইয়ুংকার বলছেন, ইউরোপীয় রাজনীতি প্রত্যয়জনক নয়, একটি যৌথ সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে রাশিয়াকে দেখানো যাবে যে, ইইউ তার মূল্যবোধের প্রতিরক্ষায় আন্তরিক৷ এখানে আবার প্রশ্ন ওঠে: যৌথ সেনাবাহিনীর ফলে পার্থক্যটা কী হবে? ইউক্রেন সংকটের সূচনা থেকে ইইউ-র ২৮টি দেশের সামরিক বাহিনী যেমন নিষ্ক্রিয় থেকেছে, যৌথ সামরিক বাহিনীও যদি সে'রকম নিষ্ক্রিয় থাকে, তাহলে সে বাহিনীকে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ থাকবে কি? ইউরোপ প্রত্যয় সৃষ্টি করতে পারে না, কারণ ইউরোপীয় রাজনীতিকরা প্রায়শই বিভিন্ন ধরনের মনোভাব প্রকাশ করেন এবং ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করেন না৷
ইইউ দেশগুলি আজও নিজেদের রক্ষা করতে অসমর্থ এবং সে'জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভর৷ এর মূল কারণ হলো, ইইউ দেশগুলির মধ্যে কেউই প্রতিরক্ষা খাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করতে রাজি নয়৷ যে কারণে জার্মানির সামাজিক গণতন্ত্রীরা ইয়ুংকারের প্রস্তাবের প্রশংসায় পঞ্চমুখ: যৌথ প্রতিরক্ষায় একক জাতীয় বিনিয়োগের প্রয়োজন কমবে, এই আশায়৷