1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
ব্যবসা-বাণিজ্যবাংলাদেশ

ঋণখেলাপিরা আছেন ক্ষমতার আশপাশেই: ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

সমীর কুমার দে ঢাকা
৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩

খেলাপি ঋণ নিয়ে নানা আলোচনা হলেও কোন সমাধান হয় না৷ বিদেশে টাকা পাচার নিয়েও নানা আলোচনা৷ এসব নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ৷

https://p.dw.com/p/4W53T
Bangladesch | Bank - Social Islami Bank
ছবি: Mortuza Rashed/DW

ডয়চে ভেলে : ব্যাংকগুলোতে যে তারল্য সংকটের কথা বলা হচ্ছে, এর কারণ কী?

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: প্রথমত এর মূল কারণ ব্যাংকগুলোর অব্যবস্থাপনা৷ তারল্য যেটাই থাকে সেটা ভালো উদ্যোক্তাদের ঋণ দেওয়া হয় না৷ ব্যাংকগুলোর পরিচালকেরা তাদের পছন্দের লোকদের ঋণ দেয়৷ ছোট, মাঝারি ও প্রকৃত ব্যবসায়ীরা কিন্তু ঋণ পাচ্ছে না৷ যেসব সেক্টরে মানুষের কর্মসংস্থান বেশি সেখানে ঋণ দেওয়া হয় না৷ টাকা আছে, কিন্তু বড় বড় ব্যবসায়ীদের সেটা দেওয়া হচ্ছে৷ তারল্য সংকট কিছুটা আছে৷ কারণ লোকজন ব্যাংকমুখী না, অনেকে ব্যাংকে টাকা রাখেন না৷ মুনাফা ৬-৯ শতাংশের ফাঁদে পড়েছে, সেটা খুবই কম৷ অর্থের উৎস না আসার আরেকটা কারণ হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকও জানে অনেক মানুষ নগদ টাকা হাতে রেখে দিচ্ছেন৷ এটা ব্যাংকের প্রতি মানুষের অনাস্থার প্রকাশ৷

ব্যাংক থেকে টাকা বেআইনিভাবে দেশের বাইরে চলে যাওয়ার সুযোগ আছে?

ব্যাংক থেকে টাকা সরাসরি যাওয়ার সুযোগ নেই৷ তবে ব্যাংকে যারা টাকা রাখে তারা তুলে নিয়ে পাঠাতে পারে৷ টাকা পাচারে ব্যাংকিং মাধ্যমের সরাসরি ব্যবহার হয় না৷ বিশেষ করে এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের নামে ওভার ইনভয়েস বা আন্ডার ইনভয়েসের মাধ্যমে বা রপ্তানি করল কিন্তু টাকাটা দেশে আনল না৷ আবার আমদানি করল সেটা বেশি দামে দেখাল, তখন ওই টাকাটা দেশের বাইরে থেকে যাচ্ছে৷ আবার অনেকে ক্যাশ টাকা ভ্রমণ করার সুযোগে নিয়ে যায়৷ পাসপোর্টে হয়ত ১০ হাজার ডলার এনডোর্স করল, সে হয়ত সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে অনেক বেশি ডলার৷ বিমানবন্দরে সম্পর্ক থাকার কারণে হয়ত তাদের ওইভাবে তল্লাশি করা হয় না৷ আরেকভাবে টাকা পাচার হয়, সেটা হল রেমিটেন্সের টাকা ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে আসার কথা৷ ধরেন এক্স দেশ থেকে একজন এক লাখ ডলার পাঠাবে৷ তখন তাকে বলা হল, ওই টাকাটা আমি এখান থেকে দিয়ে দিচ্ছি, তুমি আমার পছন্দমতো জায়গায় ওই ডলারগুলো দিয়ে দাও৷ এটাই হল হুন্ডি৷ এভাবেও টাকা পাচার হয়৷

ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ কমানোর উদ্যোগ নিলেও সেই চেষ্টা সফল হয় না কেন?

প্রথমত, ব্যাংকগুলো যে ঋণ দিয়েছে সেটা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে, নিজেদের খাতিরের লোককে৷ এগুলো সঠিক লোকের হাতে যায়নি৷ দ্বিতীয়ত, কিছু ঋণ গেছে ডাইভার্ট হয়ে৷ যেমন ১০ কোটি টাকা নিল, এটা হয়ত তার লাগবে না৷ ৫ কোটি টাকা হয়ত ব্যবসায় লাগিয়েছে, ৫ কোটি হয়ত অন্যদিকে নিয়ে গেছে৷ স্বাভাবিকভাবে সে শোধ করতে পারবে না৷ কারণ পুরো টাকা তো সে ব্যবসায় লাগায়নি৷ তৃতীয়ত, যাদের রাজনৈতিক যোগাযোগ আছে তাদের ঋণ খেলাপি হলেই বা কী, না হলেই বা কী? তারা তো এক জায়গা থেকে ঋণ নেওয়ার পর আরেক জায়গা থেকে ঋণ নিচ্ছে বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিচ্ছে৷ বাংলাদেশে তো সমন্বিত সিস্টেম নেই যে, এক জায়গা থেকে ঋণ নিলে অন্য জায়গা থেকে ঋণ নেওয়া যাবে না৷ এই সুযোগটাই তারা নিয়ে নিচ্ছে৷ সবচেয়ে বড় কথা হল, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কমার্শিয়াল ব্যাংকগুলোকে যথেষ্ট চাপ দেওয়া হয় না৷ কমার্শিয়াল ব্যাংকগুলোর পরিচালকদের তো সবাই চেনা-জানা খাতিরের৷ সেই কারণে খুব উদ্যোগ নিয়ে ঋণ আদায় করা হয় না৷ এটা না করলে কারও শাস্তিও হয় না৷ সবকিছু মিলিয়ে আমি বলব, নিয়ন্ত্রক সংস্থা, ব্যাংকগুলোর দুর্বলতা, রাজনৈতিক যোগাযোগের কারণে ঋণ উদ্ধার হয় না৷ আর সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংক তো তাদের ছাড়ও দিচ্ছে৷

ঋণখেলাপিদের সবারই সরকারের সঙ্গে বিশেষ যোগাযোগ আছে: ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

সরকার বারবার কেন বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে ঋণখেলাপিদের বিশেষ সুবিধা দেয়?

সরকার সুযোগ দেয় এই কারণে যে, যারা ঋণখেলাপি তাদের সবারই তো সরকারের সঙ্গে বিশেষ যোগাযোগ আছে৷ ক্ষমতার আশপাশে যারা আছে তারাই তো ঋণখেলাপি৷ একটা উদাহরণ দেই, সম্প্রতি এক লাখেরও বেশি কৃষকের বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট মামলা হয়েছে৷ কারণ কৃষকরা ঋণ শোধ করছে না৷ সার্টিফিকেট মামলা হল, কঠিন মামলা৷ এখানে তাদের কাছে ৩০০ কোটি টাকার মতো পাবে৷ অথচ হাজার হাজার কোটি টাকা একজনই নিয়ে গেছে৷ অথচ তার বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে না৷ এ ব্যাপারে যদি সরকারের সঠিক সদিচ্ছা না থাকে এবং যারা ব্যাংক চালায় তাদের যদি সঠিক নিষ্ঠা, সততা, দক্ষতা না থাকে তাহলে কীভাবে ঋণ আদায় হবে? ইচ্ছা না থাকলে কীভাবে ঋণ আদায় হবে? যারা ঋণ শোধ করে, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, কৃষক তাদের উপর চাপ বেশি৷ এটা অদ্ভুত একটা ব্যাপার৷

একজন সাধারণ মানুষ ঋণ পেতে নানা ধরনের কাগজপত্র দিতে গিয়ে হিমশিম খায়৷ কিন্তু শত শত কোটি টাকা ঋণ সহজেই হয়ে যায়৷ কারণ কী?

এর কারণ হল, ব্যাংক এদের চেনে বা এদের সঙ্গে ভালো যোগাযোগ আছে বা এদের প্রভাব আছে৷ ঋণ তো দেওয়ার কথা পেশাদারত্বের সঙ্গে আর্থিক রুলস মেনে৷ সবকিছু দেখেই দেওয়ার কথা৷ এখন তো এসব দেখা হয় না৷ ব্যাংকের নিয়মগুলো সঠিকভাবে পালন করা হচ্ছে না৷

প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত ব্যাংকের অনুমোদনই কী ব্যাংকের শৃঙ্খলা না থাকার কারণ?

এত ব্যাংকের আধিক্য অন্য কোথাও নেই৷ অর্থনীতির এই সাইজে এত ব্যাংক অন্য কোন দেশে নেই৷ সাবেক অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, নতুন এই ব্যাংকগুলোর অনুমোদন দেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে৷ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে কেন ব্যাংক দেওয়া হবে? প্রথমত, নতুন ব্যাংকের প্রয়োজন আছে কিনা? পাশাপাশি দিতে হলে প্রতিষ্ঠিত উদ্যোক্তাদের দিতে হবে৷ যারা এই ব্যাংককে নিয়ে যাবেন প্রত্যন্ত অঞ্চলে৷ যারা ব্যাংকিং লেনদেনের বাইরে তাদের কাছে৷ পাশাপাশি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা যারা তাদের স্বার্থে ব্যাংক হতে পারে৷ নতুন ব্যাংকগুলো তো সেটা করছে না৷ এখন সবগুলো ব্যাংকই একই গ্রাহকের কাছে যাচ্ছে৷ ফলে সেখানে অসুস্থ একটা প্রতিযোগিতা হচ্ছে৷ আমাদের দেশে তো এখনও ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ মানুষ ব্যাংকে আসে না৷ নতুন ব্যাংকগুলো কী করছে? আন্তর্ভূক্তিমূলক তো হচ্ছে না৷ নগদ-বিকাশ যেটা করছে সেটা তো ব্যাংকিং না৷ এখন জিনিসটা আরও বেশি খারাপের দিকে যাচ্ছে৷

ব্যাংক খাত ধ্বংসে সবসময়ই সরকারের লোকজন জড়িত? বিষয়টি কী এমন?

সরকার এখানে সরাসরি জড়িত না৷ এখানে জড়িত সরকারের মদতপুষ্ট ব্যবসায়ীরা৷ পাশাপাশি সরকার আর ব্যবসায়ীদের মধ্যে একটা এজেন্ট গ্রুপ আছে৷ তাদের আবার ব্যাংকের সঙ্গে সুসম্পর্ক আছে৷ তারা ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করে কমিশন নিচ্ছে৷ সব মিলিয়ে এখানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব আছে৷ এখানে প্রক্রিয়াগুলো স্বচ্ছ না৷ শুধু রাজনীতিবিদ না, এখানে অনেক রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকের পরিচালক আছে আমলা৷ তাদের এখানে দিতে হবে কেন? এখানে তো পেশাদার বা অর্থনীতিবিদ বা উন্নয়ন গবেষক দেওয়ার কথা৷ ব্যাংক তো সরকারি কর্মচারীদের পুনর্বাসন কেন্দ্র হতে পারে না৷ পরিচালকদের ব্যর্থতা বা স্বচ্ছতার অভাবের কারণে কিন্তু এই অবস্থা হয়েছে৷

কী পদক্ষেপ নিলে ব্যাংকগুলোকে শৃঙ্খলার মধ্যে ফিরিয়ে আনা যাবে?

প্রথমত, আমাদের দেশে যেটা দরকার সেটা হল, রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলো সরকার নিয়ন্ত্রণ করে৷ সেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ কম৷ সব ব্যাংকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে নিতে হবে৷ দ্বিতীয়ত, আমাদের দেশে বাংলাদেশ ব্যাংকের যে রুলস রেগুলেশন আছে সেটা কিন্তু আন্তর্জাতিক মানের৷ ফলে এটা পরিপালন করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে শক্ত অবস্থান নিতে হবে৷ তৃতীয়ত, বাংলাদেশ ব্যাংকে কোন রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করা যাবে না৷ রাজনীতিবিদেরা পরামর্শ দিতে পারেন কিন্তু একে ঋণ দাও ওকে ঋণ দাও সেটা বলতে পারবেন না৷ এই প্রেশারটা নেওয়ার সক্ষমতা বাংলাদেশ ব্যাংকের থাকতে হবে৷ কমার্শিয়াল ব্যাংকে সব রুলস পরিপালন করতে হবে৷ কেউ সেটা না করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে৷ সবশেষে রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন৷ আর আমলারা যারা কিছুই জানে না তাদের এখানে হস্তক্ষেপ মোটেই কাম্য না৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য