1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ই-রিটার্নের পথে বাংলাদেশ

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
২৮ অক্টোবর ২০২৪

বাংলাদেশে অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিলের দিকে যাচ্ছে সরকার। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিসহ কয়েকটি সেক্টরে এবার ই-আয়কর রিটার্ন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এটা বাড়বে।

https://p.dw.com/p/4mJwN
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস আয়কর প্রদানের পথ সহজ করেছেন৷
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসছবি: Sazzad Hossain/DW

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ঘরে বসে ঝামেলামুক্তভাবে আয়কর জমা দেয়ার জন্যই এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড গত ২২ অক্টেবর চার ধরনের ব্যক্তির ই-রিটার্ন  চলতি বছর থেকেই বাধ্যতামূলক করার আদেশ জারি করে। এই তালিকার প্রথমে আছেন: ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনে অবস্থিত আয়কর সার্কেলসমূহের অধিক্ষেত্রভুক্ত সব সরকারি-কর্মচারী। তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে আছেন সব তফসিলি ব্যাংকের কর্মকর্তা ও কর্মচারী। তৃতীয়ত, দেশের সব মোবাইল টেলিকম সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মকর্তা বা কর্মচারী। এ ছাড়া ছয়টি বড় বিদেশি কোম্পানিতে কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদেরও বাধ্যতামূলকভাবে অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হবে। এই কোম্পানিগুলো হলো: ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেড, ব্রিটিশ অ্যামেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেড, ম্যারিকো বাংলাদেশ লিমিটেড, বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেড, বাটা শু কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেড এবং নেসলে বাংলাদেশ পিএলসি। 

‘বাংলাদেশে কর দিতে সক্ষম অনেকেই কর দেন না’

সোমবার  প্রধান উপদেষ্টা এক ভিডিও বার্তায় বলেন," দেশের বাকি সবাইকে অনলাইনে ই-রিটার্ন ও আয়কর জমা দেওয়ার জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে।

তার কথা, "আপনাদের দেয়া করই দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। অথচ সরকারের কাছে করের টাকা জমা দিতেই পোহাতে হয় নানা ঝামেলা। এখন থেকে ব্যাংকে লাইন দিয়ে আয়কর জমা দেওয়া বা আয়কর অফিসে গিয়ে রিটার্ন জমা দেওয়ার ঝামেলা করতে হবে না। আপনি ঘরে বসেই আয়কর জমা দিয়ে রিটার্ন দাখিল করবেন এই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।”

কোন প্রতিষ্ঠান কত বেশি করদাতার আয়কর রিটার্ন অনলাইনে দিচ্ছেন, তার ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার অর্জনের জন্য জেলায় জেলায়, শহরে শহরে প্রতিযোগিতার কথাও বলেন তিনি।

অনলাইনে আয়কর রিটার্ন জমা দেয়ার ক্ষেত্রে পরস্পরকে সহযোগিতা করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন,"আপনার আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধবকে শিখিয়ে দিন কিভাবে ঘরে বসে অনলাইনে ই-রিটার্ন ও আয়কর জমা দিতে হয়। তরুণ-তরুণীদের অনুরোধ করছি, এই ব্যাপারে করদাতাদের সাহায্য করার জন্য। ভবিষ্যতে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রস্তুতি এখান থেকেই শুরু হতে পারে।”

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান বদিউর রহমান বলেন," আয়কর দাতার সঙ্গে গ্রহীতার দেখা যত কম হবে, ঝামেলা বা অনিয়ম তত কম হবে। সেই দিক থেকে এটা ভালো উদ্যোগ। তবে ই-রিটার্নের জন্য করদাতাদের প্রশিক্ষিত করতে হবে। আর কর বছরের শেষ পর্যায়ে এসে এই ঘোষণা সমস্যা তৈরি করতে পারে। আগাম প্রস্তুতি দরকার ছিল।”

বাংলাদেশে আয়কর ব্যবস্থা

বাংলাদেশে এখন বছরে আয় তিন লাখ ৫০ হাজার টাকার বেশি হলেই আয়কর দিতে হয়। তবে আয়কর দেয়ার জন্য টিআইএন খুলতে  আয়ের কোনো বাধ্যবধকতা বা সীমা নেই। আর ৪৩ ধরনের সরকারি সেবা পেতে টিআইএন লাগে।

নিয়ম অনুযায়ী আয়ের প্রথম তিন লাখ ৫০ হাজার টাকার ওপর কোনো কর দিতে হবে না। পরবর্তী এক লাখ টাকার ওপর পাঁচ শতাংশ, পরবর্তী চার লাখ টাকায় ১০ শতাংশ, পরবর্তী পাঁচ লাখ টাকায় ১৫ শতাংশ, পরবর্তী পাঁচ লাখ টাকার ওপর ২০ শতাংশ, পরবর্তী ২০ লাখ টাকার ওপর ২৫ শতাংশ এবং অবশিষ্ট টাকার ওপর ৩০ শতাংশ আয়কর দিতে হয়।

আয়কর পরিস্থিতি

আয়কর দেয়ার জন্য টিআইএন লাগে। বাংলাদেশে টিআইএনধারীর সংখ্যা বর্তমানে এক কোটি চার লাখ। কিন্তু ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে আয়কর জমা দিয়েছে মাত্র ৪৩ লাখ টিনধারী। ৫৯ শতাংশ তাদের রিটার্ন জমা দেননি। তবে এটা আগের বছরের চেয়ে ২২ ভাগ বেশি।

বর্তমানে ৪৩টি  সরকারি সেবা নিতে টিআইএন প্রয়োজন হওয়ায় অনেকেই তা নিলেও আয়কর রিটার্ন জমা দেন না। এনবিআরের জরিপ বলছে, পাঁচ লাখ মানুষ আয়কর রিটার্ন জমা দেন না, কারণ তারা শুধু জমি হস্তান্তরের জন্য টিআইএন নিয়েছেন। চার লাখ মানুষ নির্দিষ্ট সেবা নিতে টিআইএন নিয়েছেন। দুই লাখের বেশি টিআইএনধারী মারা গেছেন। তিন লাখ টিআইএনধারী বিদেশে। বাকি যারা রিটার্ন জমা দেন না তাদের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কারণ জানাতে পারছে না এনবিআর। মূলত সচেতনতার অভাবকে সাধারণভাবে দায়ী করছে তারা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং অর্থনীতি নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ কমিশনের সদস্য ড. সেলিম রায়হান বলেন," গত সরকারের হিসাবে বাংলাদেশের মানুষের যে মাথা পিছু আয় সেই তুলনায় কর দাতার সংখ্যা কম।  যে পরিমান টিআইএনধারী আছেন ১৭ কোটি মানুষের দেশে সেই সংখ্যা তার চার গুণ হওয়া উচিত। আরেকটি দিক হলো তারপরও যে এক কোটির বেশি কিছু লোকের টিআইএন আছে, তাদের মধ্যে অর্থেকেরও কম আয়কর দেন।”

"বাংলাদেশে কর দিতে সক্ষম অনেকেই কর দেন না। তারা কর ফাঁকি দেন। তাদের করের আওতায় আনার সুযোগ আছে। এর জন্য প্রয়োজন সক্ষমতা এবং উদ্যোগ।  কারণ, অনেকে এনবিআরের লোকজনের সঙ্গে নানা ধরনের যোগসূত্র স্থাপন করে কর ফাঁকি দেন। আবার অনেকে জটিল প্রক্রিয়া এবং ভয়ের কারণে কর দেন না। তারা মনে করেন, টিআইএনধারী হলে এএনবিআর পেয়ে বসবে। হয়রানির শিকার হবেন। এর অবসান হওয়া প্রয়োজন,” বলেন তিনি।

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান বদিউর রহমান বলেন," যারা টিআইএন নেন, তাদের এক গ্রুপ আছেন জমি রেজিষ্ট্রেশনের জন্য। আবার অনেকে নেন নানা ধরনের সেবা পেতে। ফলে বড় একটি অংশ আয়কর রিটার্ন জমা দেন না। আসলে কর আদায়ে দক্ষতা এবং সততা প্রয়োজন। শুধু শহরে নয়  গ্রামেও অনেক লোক আছেন কর দেয়ার যোগ্য হলেও কর দেন না। তাদের  ব্যাপারে তো তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। সেটা করা দকার। গ্রামে অনেক লোকেরই বাড়ি-গাড়ি আছে এখন। তারা করের আওতায় আসছেন না।”

" ওয়ান ইলেভেনের সময় আমি ঢাকায় যারা বাড়ি, ফ্ল্যাটে থাকেন সরাসরি তাদের বাসায় গিয়ে জরিপ করার  উদ্যোগ নিয়েছিলাম। জনপ্রতিনিধিদেরও সম্পৃক্ত করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেটা আমাকে করতে দেয়া হয়নি। এইভাবে সারা দেশেই করা যায়। এটা করলে  আয়করদাতা বাড়বে।”

বাংলাদেশ ট্যাক্সেস বার অ্যাসেসিয়েশনের সাবেক সভাপতি এম এ মতিন বলেন, "এনবিআরে জনবলের অভাব আছে। আর যারা কর দেয়ার যোগ্য, তাদের চিহ্নিত করতে তাদের ভালোভাবে জরিপ করা দরকার। আসলে অনেকেই আছে নানা নাগরিক-সুবিধা নেয়ার জন্য টিআইএন নেন, কিন্তু রিটার্ন জমা দেন না।  টিআইএন থাকলে  প্রয়োজনে জিরো ট্যাক্সেও রিটার্ন জমা দেয়া বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। আর হয়রানি কমাতে হবে। তাহলে রিটার্ন জমা দিতে মানুষের আগ্রহ বাড়বে।” 

‘কর আদায়ে দক্ষতা এবং সততা প্রয়োজন’

চলতি অর্থবছরে এনবিআর রাজস্ব খাতে মোট আয়ের লক্ষ্য ঠিক করেছে চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ভ্যাট এক লাখ ৮২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। আয়কর থেকে এক লাখ ৭৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।

ই-রিটার্ন

এম এ মতিন বলেন," ই-রিটার্ন আয়কর রিটার্ন দাখিলকে সহজ করবে। ঝামেলা ও হয়রানিমুক্ত করবে বলে এনবিআরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। তবে এটা চালু হলে এর সুফল সম্পর্কে পুরোপুরি ধারণা পাওয়া যাবে।”

ই-রিটার্ন প্রসঙ্গে অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, "এই ধরনের ডিজিটাল ব্যবস্থা কর আদায়ের ক্ষেত্রে হয়রানি ও যোগাযোগের মাধ্যমে কর ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা কমাবে। তবে এই ব্যবস্থাই যথেষ্ট নয়। কর খাতে অব্যবস্থা আর দুর্নীতি দূর করতে হলে দুর্নীতি আর অব্যবস্থপনার জায়গাগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।”

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান বদিউর রহমান বলেন, " অনলাইনে আয়কর রিটার্ন জমা দেয়ার বিধানে একটা সুবিধা হবে যে পার্সোনাল যোগাযোগ না থাকলে এনবিআরের যেসব বদনাম আছে, তা কমবে। ব্যক্তি পর্যাযে যোগাযোগ করে সুবিধা নেয়া বা হয়রানির ঘটনা কমবে। তবে আরেকটা সমস্যা হতে পারে। অনলাইনে অনেকেই অভ্যস্ত নয়। বছরের শেষ সময়ে অনলাইনে আয়কর জমা দিতে গিয়ে তারা অসুবিধায় পড়তে পারেন। এজন্য প্রচার ও প্রশিক্ষণের প্রয়োজন ছিল।”