1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ইউরোপে ধর্মের কল কে নাড়ে?

ডয়চে ভেলের সাংবাদিক যুবায়ের আহমেদ৷
যুবায়ের আহমেদ
২২ এপ্রিল ২০২২

একটা অভিযোগ প্রায়ই চোখে পড়ে, ইউরোপে ধর্ম পালন করা কঠিন৷ এখানে মুসলিম ও ইহুদিরা সবচেয়ে বেশি সংকটে৷ ঠিক ধর্ম পালনে নয়, কিছু কিছু ধর্মীয় নিয়ম পালনে কোথাও কোথাও বিধিনিষেধ থাকলেও, সার্বিকভাবে উলটো চিত্রই চোখে পড়ে৷ 

https://p.dw.com/p/4AIcY
Frankreich Moschee Islam Religion
ফ্রান্সের একটি মসজিদছবি: Vanessa Meyer/dpa/picture alliance

এবার এক ভিন্ন প্যারিস দেখে এলাম৷ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহ করাই ছিল এবারকার রথ দেখার উদ্দেশ্য৷ সঙ্গে কলা তো বেঁচতেই হবে৷ একটুখানি আইফেল না হলে কি হয়? কিংবা সিইন নদীর কুলকুল করা স্রোত লুভ মিউজিয়ামের দেয়ালের পলেস্তারা কতটা খসালো, সেসব দেখেই বনে ফিরেছি৷ বন মানে জার্মানির বন শহর৷ জঙ্গল ভেবে ভুল করবেন না যেন!

যাই হোক, আসল কথায় ফিরি৷ মধ্যপন্থি এমানুয়েল মাক্রোঁ আর অতিডানপন্থি ল পেনের লড়াই, অতি বামপন্থার প্রতি তরুণ অভিবাসী প্রজন্মের ভরসা, ধর্মীয় আচরণে কর্তৃপক্ষের প্রভাব, আর নির্বাচনের হিসেব নিকেষে এসব কতটা ফ্যাক্টর- এগুলো একটু খতিয়ে দেখতে প্যারিসের বিভিন্ন জেলার পথ যেমন মাড়িয়েছি, তেমনি সফরের সিংহভাগ কেটেছে অভিবাসীপ্রধান এলাকাগুলোতে৷

যেমন, প্যারিসের সেন্ট্রাল স্টেশন গার দ্যু নর্দের পাশেই ১০ নম্বর সাবডিভিশন৷ সেখানে গেলে চোখে পড়বে সারি সারি দোকান, খাবারের হোটেল কিংবা ছোট ছোট ব্যবসা৷ কোনোটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের৷ কোনোটি মোবাইলের দোকান৷ দেখলে মনে হবে হাতিরপুল বা এলিফ্যান্ট রোডে এসে পড়েছেন৷ হাঁটতে গেলে বাংলা কথা শুনবেন৷ চোখে পড়বে বাংলা লেখা সাইনবোর্ডও৷ অনেকগুলো মানি এক্সচেঞ্জের দোকানও রয়েছে এখানে৷ কারণ, এসব এলাকায় অভিবাসীর সংখ্যাই বেশি৷ বিশেষ করে অনেক বাংলাদেশির ব্যবসা গড়ে উঠেছে এখানে৷ আমাদের এখানে আসার উদ্দেশ্য, প্যারিসে অভিবাসীরা কেমন আছেন? বাংলাদেশিরা কেমন আছেন? মুসলিমসহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষ কেমন আছেন, তা স্বচক্ষে দেখা৷

যা দেখলাম, প্রথমত, নানা টানাপোড়েনের মাঝেও প্যারিসের বাংলাদেশিরা ভালো আছেন৷ তারা যখন ফ্রান্সে আসছেন, অনেক পয়সা খরচ করে নিয়মিত বা অনিয়মিত উপায়ে, তখন শুরুতে বেশ কষ্ট করছেন৷ কিন্তু এখানে একটা কমিউনিটি গড়ে উঠেছে৷ সেই কমিউনিটির কারো কারো সহযোগিতায়ই হোক, ব্যবসায়িক স্বার্থেই হোক, তাদের অনেকেই পরের দিকে বেশ ভালো করছেন৷ অনেক উদাহরণ দিতে পারব৷ কিন্তু সেসবে এখন যাচ্ছি না৷

বরং দেখা যাক, ধর্মের কল এখানে কে নাড়ায়? সরকার? শহর কর্তৃপক্ষ? নাকি যার যার ধর্মীয় কমিউনিটি? আমার অভিজ্ঞতা হলো, বাইরে থেকে অনেক কথা শোনা গেলেও প্যারিসের মুসলিম কিংবা অন্য ধর্মের মানুষেরা অনেক স্বাধীনতা নিয়েই ধর্মচর্চা করতে পারেন৷ যেমন, প্যারিসের স্তাঁ জেলার একটি বাংলাদেশি মুসলিম কালচারাল সেন্টারে যাবার অভিজ্ঞতা হলো৷ দোতলা একটা বাড়ি৷ সামনে লেখা, ‘বাংলাদেশ কমিউনিটি মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টার’৷ বিশাল কাঠের দরজা, কারুকার্য করা৷ নীচতলায় একাধিক ক্লাসরুম৷ সেখানে বাংলাদেশিসহ অন্যান্য আরব দেশের শিশুরা ইসলাম বিষয়ে পাঠ নিচ্ছে৷ মসজিদের ইমাম নিজে পড়াচ্ছেন শিশুদের৷

কথা হচ্ছিল এই কালচারাল সেন্টারের সভাপতি সেরাজুল ইসলাম সালাউদ্দিনের সঙ্গে৷ তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, ধর্ম পালন করা কিংবা এমন একটা কালচারাল সেন্টার ও মসজিদ পরিচালনা করতে গিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো নিয়ম কানুন চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে কি না? তিনি বললেন, যেহেতু এই সেন্টারে শিক্ষা নেয়া শিশুর সংখ্যা কয়েকশত ছাড়িয়ে গেছে, এবং দিন দিন সংখ্যা বাড়ছে, তাই সরকার বলেছে, কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে ইমারজেন্সি সিঁড়ি কিংবা শারীরিক প্রতিবন্ধীবান্ধব কিছু অবকাঠামোগত পরিবর্তন করা দরকার৷ সেটি তারা করেছেন৷ এর বাইরে ইমাম নিয়োগের সময় সরকার কিছু প্রশিক্ষণের কথা বলছে৷ তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি৷ এই প্রশিক্ষণ মূলত ইমামরা যখন আরব দেশ বা বাংলাদেশ থেকে এখানে সরাসরি আসেন, তখন এখানকার যে নিয়মকানুন সম্পর্কে না জেনে যেন কথা না বলেন, সেজন্য তাদের সেসব বিষয় অবহিত করা৷ অন্য কিছু নয়৷ এখানে যার যার ধর্ম পালনের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা আছে বলে মনে করেন তিনি৷

সভাপতির এসব কথা যেমন সত্য, তেমনি এটিও সত্য যে, এখানকার দক্ষিণপন্থি রাজনীতিতে অভিবাসন ও ধর্মবিদ্বেষ একটা ইস্যু হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে৷ তবে এখনও এটি অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান কিংবা পেনশন-এসব বিষয়ের মত অত বড় বিষয় নয়৷ এমনটিই বলছিলেন আজেদিন তাইবি৷ তিনি প্যারিসের স্তাঁ শহরের মেয়র৷ আলজেরীয় বংশোদ্ভূত৷ তিনি বললেন, শহরের বাইরে কিছু কিছু পকেট আছে, যেখানে ধর্মবিদ্বেষের ইস্যুটিকে কাজে লাগিয়ে ভোট বাগানোর চেষ্টা করেন অনেকে৷ কিন্তু সার্বিকভাবে এটা মোটেই ফ্রান্সের রাজনীতির মূল ইস্যুগুলোর মধ্যে পড়ে না৷

যুবায়ের আহমেদ, ডয়চে ভেলে
যুবায়ের আহমেদ, ডয়চে ভেলে

বাংলাদেশিদের অনেকেই বললেন, এখানে যেমন মুসলিম বা ইহুদিবিদ্বেষের ঘটনা ঘটে না, তা নয়৷ আবার মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের মধ্য থেকেও সন্ত্রাসী হামলা চালানো হয়েছে৷ ২০১৫ সালের প্যারিস, ২০২০ সালে স্যামুয়েল প্যাটিকে হত্যা কিংবা নিসের হামলার ঘটনাও ঘটেছে৷ তাদের ভয়, উভয়দিকের এসব ঘটনা সার্বিকভাবে সবার সহাবস্থানকে হয়তো ভবিষ্যতে কঠিন করে তুলবে৷ বিশেষ করে সাধারণ অভিবাসীদের জন্য৷ তবে এখনই তেমন অবস্থা তৈরি হয়নি বলেও বলছেন তারা৷ বরং যেসব এলাকায় মুসলিমদের সংখ্যা বাড়ছে, সেখানে মসজিদও তৈরি হচ্ছে৷ সরকার সন্ত্রাসবিরোধী কিছু নিয়ম কানুন কড়াকড়ি করেছে বটে, এবং তা নিয়ে সবাই খুশিও নয়৷ কিন্তু একইসঙ্গে এটাও সত্য, এদেশের নিয়ম কানুন, সংস্কৃতি ও ভাষা এসব সম্পর্কেও সম্যক জ্ঞান থাকা জরুরি, যা অনেক অভিবাসীই অনুসরণ করতে চান না৷

এমনকি জার্মানির কথাও বলতে পারি৷ এখানে কারো ধর্ম, বর্ণের ওপর আঘাতকে বড় অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়৷ এখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে সবার ধর্ম পালনের অধিকার সংরক্ষিত৷ এখন কিছু মানুষ অন্য ধর্ম বা বর্ণের মানুষের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করছেন, এটিও যেমন সত্য, তেমনি রাষ্ট্র সবার মত ও বিশ্বাস পালনের অধিকার সংরক্ষণ করার জন্য আইন রেখেছে এবং তার প্রয়োগও করছে৷

ইউরোপে অন্তত যার যার ধর্ম তার তার কাছে, এমন নীতিতে বিশ্বাসীদের সংখ্যা অনেক বেশি বলেই মনে হয়৷ সংঘাত যা দেখি, তা সাংস্কৃতিক৷ এখানকার পোশাক, ভাষা ও সাংস্কৃতিক আচার আরব কিংবা দক্ষিণ এশীয় সংস্কৃতি, তা ধর্মীয় হোক বা সামাজিক, তা থেকে আলাদা৷ মূলত সমস্যা হয়, যখন একের সংস্কৃতি অন্যের ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়৷ যদি সবাই খোলা মনে একে অন্যের ভাষা, আচার সম্পর্কে জানেন এবং শ্রদ্ধা করেন, তাহলে আমার সাদা চোখে কোনো সংকট আর ধরা পড়ে না৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য