আয়করে অনীহার যত কারণ
৩০ নভেম্বর ২০২২বাংলাদেশে মোট টিআইএনধারীর সংখ্যা ৮২ লাখ। কিন্তু ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত আয়কর জমা দিয়েছেন চার ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ২২ লাখ টিআইএনধারী। এটা গত বছরের চেয়ে বেশি বলা হলেও চিত্র হতাশাজনক। তাই রিটার্ন দাখিলের সময় আরো একমাস বাড়িয়ে ৩১ ডিসেম্বর করা হয়েছে।
বাংলাদেশে ব্যক্তিগত আয়ের করমুক্ত সীমা হলো বছরে তিন লাখ টাকা। এরপর তিন লাখ থেকে এক লাখ পর্যন্ত শতকরা পাঁচ ভাগ। এরপর বিভিন্ন শ্লটে ভাগ করে সর্বোচ্চ আয়কর শতকরা ২৫ ভাগ। শতকরা ২৫ ভাগ ১৬ লাখ পরবর্তী বাৎসরিক আয়ের ওপর কর দিতে হয়। তবে লিঙ্গ, বয়সসহ আরো কিছু বিবেচনায় করমুক্ত আয়সীমার কিছু সুবিধা দেয়া আছে।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল এর আগে বলেছেন বাংলাদেশে কমপক্ষে চার কোটি মানুষ ব্যক্তি আয়কর দিতে সক্ষম। অর্থনীতিবিদ ও আয়কর বিশ্লেষকেরাও মনে করেন এই সংখ্যা কমবেশি এরকমই হবে। কিন্তু নিয়মিত কর দাতা ৩০ লাখের বেশি না। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে দেশে এখন কোটিপতির সংখ্যা এক লাখ আট হাজার ৪৫৭। এটা ব্যাংকে যাদের কোটি টাকার বেশি আছে তাদের হিসাব। বাস্তবে এই কোটিপতির সংখ্যা আরো বেশি হবে। কোটিপতির সংখ্যা আবার বাড়ছে। এক বছর আগে কোটিপতির সংখ্যা ছিলো এক লাখ ৯৭৬।
যাদের সম্পদের পরিমাণ অনেক বেশি তাদের আবার সারচার্জ দেয়ার বিধান আছে আয়কর আইনে। যেমন সম্পদ ৫০ কোটি টাকার বেশি হলে শতকরা ৩৫ ভাগ সারচার্জ দিতে হয়। আবার সম্পদের পরিমাণ তিন কোটি থেকে ১০ কোটি টাকার হলে শতকরা ১০ ভাগ সারচার্জ দিতে হয়। কিন্তু লাখেরও বেশি কোটিপতি ব্যাংক একাউন্টধারীর দেশে সারচার্জ দেন মাত্র ১৫ হাজার ব্যক্তি।
এখানে স্পষ্ট যে ধনীরাই আয়কর দিতে চাননা। আর মধ্যবিত্তও তাই। কিন্তু আয়কর দেয়ার যোগ্য ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার কার্যকর কোনো উদ্যোগও এনবিআরের নাই। তবে কিছু সেবা পেতে এখন হালনাগাদ টিআইএন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ৩৮ ক্যাটাগরিতে প্রায় ১০০ ধরনের সেবা পেতে হালনাগাদ আয়কর রিটার্ন লাগে।। তার মধ্যে জমিজমা, ফ্লাট ও গাড়ি কেনা, পাঁচ লাখ টাকার বেশি ঋণের আবেদন, অস্ত্রের লাইসেন্স, এলসি খোলা, নির্বাচনে দাঁড়ানো ইত্যাদি।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন,"বাংলাদেশে যত লোকের টিআইএন আছে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি লোকের আয়কর দেয়ার সক্ষমতা আছে। চার বছর আগে সিপিডির এক গবেষণায় দেখা গেছে দেশের কোটিপতিদের ৬৭ শতাংশই কর দেন না। তাহলে আপনি বুঝতেই পারছেন যে কী পরিমাণ লোক করের বাইরে আছেন।”
তিনি মনে করেন,"একটি সমন্বিত কর আদায় পদ্ধতি দরকার। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যে মাধ্যমেই অর্থের লেনদেন করুক না কেন তা যেন জানা যায়। তাহলে তাদের করের আওতায় আনা যাবে। সিস্টেমকে পুরোপুরি ডিজিটাল করতে হবে। ভারতে আধার কার্ড-এর মাধ্যমে কিন্তু সেখানকার নাগরিকদের আয় ব্যয় জানা যাচ্ছে। আমাদেরও এরকম দরকার।”
এনবিআরের সবেক চেয়ারম্যান ড. বদিউর রহমান বলেন, "বাংলাদেশের যা আর্থিক অবস্থা তাতে আসলে যত লোকের টিআইনএন নাম্বার আছে তার কমপক্ষে পাঁচ-ছয় গুণ লোকের কর দেয়ার ক্ষমতা আছে। কিন্তু তারা করের আওতায় নেই। আর অনেক ধনী লোকই সারচার্জ দেয় না। যারা দেয় তাদের মানুষ বোকা মনে করে।”
তার কথা,"এখানে কর দিলে হয়রানির শিকার হতে হয়। বরং কর না দিলে, অর্থপাচার করলে ভালো থাকা যায়। তাই মানুষ কর দেয়না। এখানে এনবিআরের কর্মকর্তাদের দুর্নীতি এবং অদক্ষতা আছে।”
তার মতে,"করযোগ্যদের চিহ্নিত করতেও এনবিআরের উদ্যোগ নেই। আর যারা কর দেয় না তাদের শাস্তিও পেতে হয় না। আমি এনবিআরের চেয়ারম্যান থাকার সময় উদ্যোগ নেয়ায় আমাকে চাকরি ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে।”