আসুন জীবনকে ভালোবাসি
১৫ অক্টোবর ২০২১মন আর শরীর আলাদা করার উপায় নেই। একটির অসুখ হলে আরেকটিরও অসুখ হয়। আর একটি ভালো থাকলে আরেকটি ভালো থাকে।
আমি শুরুতেই বলে নিই, স্বাস্থ্য তো দূরের কথা আমি মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারেও কোনো বিশ্লেষক বা বিশেষজ্ঞ নই । আমার পড়াশুনার বিষয়ও নয়। তবে সাংবাদিক হিসেবে প্রতিবেদন করতে গিয়ে আমার মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে যা জেনেছি তা-ই এখানে শেয়ার করছি।
কয়েকদিন আগে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক কিশোরীর মৃত্যু হয়েছে। সে মারা গেছে আগুনে পুড়ে। সেই পরিবারের সদস্যদের দুই-একজনের সাথে আমার পরিচয় আছে। আগুনে পোড়ার কারণ জানতে পেরে আমি হতবাক হয়ে পড়ি। পরিবারের লোকজন ফেসবুক ব্যবহারে বাধা দেয়ায় সে অভিমান করে নিজের শরীরে নিজেই আগুন ধরিয়ে দেয়। ঘটনার তিন দিন পরে তার মৃত্যু হয়। পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলে জানতে পারি, করোনার সময় বাইরে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। তখন সে মেবাইল ফোনে ফেসবুকে আসক্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু তাকে এই আসক্তি থেকে ফেরাতে কোনো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার না করে সরাসরি বাধা দেয়ায় এই পরিণতি।
কুয়েটের এক শিক্ষার্থীর সাথে কথা হয়েছে গত সপ্তাহেই। করোনার শুরুতে যখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়, সে তখন তার ঢাকার বাসায় চলে আসে। এখানে এসে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আর এই বিচ্ছিন্নতা তাকে মোবাইল ফোনে আসক্ত করে তোলে। পরিবারের সদস্যদের আচরণও সে মেনে নিতে পারেনি। ফলে তার রাতে ঘুম হতো না। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। এমনকি বাসার জিনিসপত্র ভাঙচুরও শুরু করে। এই পরিস্থিতিতে তার পরিবার কিন্তু তার ওপর চাপ সৃষ্টি করেনি। মনোচিকিৎসকের সহায়তা নিয়েছে। কাউন্সেলিং করিয়েছে। ফলে সে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে।
নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষার্থী নিজেই নিজের মনকে সঠিক পথে রাখার ব্যবস্থা করে সফল হয়েছেন। তিনি শুরুতে অনলাইন ক্লাসে অভ্যস্ত হতে পারেননি। দুই বিষয়ে অনলাইন পরীক্ষায় খারাপ করেন। নতুন করে আবার পরীক্ষা দিতে গিয়ে তার পরিবারের ওপর আর্থিক চাপ পড়ে। তা তাকে বিপর্যস্ত এবং হতাশাগ্রস্ত করে। অনলাইনে নানা গেমে আসক্ত হয়ে পড়েন তিনি। এরপর নিজেই তিনি একটি অনলাইন পোশাকের দোকান খুলে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এখন তার ব্যবসাও ভালো চলছে। লেখাপড়াও ভালো হচ্ছে।
এই তিনটি জীবনের গল্পের মধ্যে আমি মনে করি মানসিক স্বাস্থ্য খারাপ হওয়ার কারণ ও তা থেকে বরিয়ে আসার কিছু ইঙ্গিত আছে।
করোনায় শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বব্যাপী মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হয়েছে। আর তা আগের তুলনায় তিন-চারগুণ বেশি। করোনার সময় আত্মহত্যার প্রবণাতাও বেড়েছে। হতাশা থেকেই আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ে। করোনায় হতাশা সৃষ্টির নানা কারণ ঘটেছে।
কেউ চাকরি হারিয়েছেন, কেউ ব্যবসা হারিয়েছেন। কেউ স্বজন হারিয়েছেন। শুধু তাই নয়, অনেকের ভবিষ্যৎও অন্ধকার হয়ে গেছে। বাল্যবিয়ে বেড়েছে। বেড়েছে ড্রপ আউট। করোনার সময় অনেকের চাকরির বয়স চলে গেছে। তারা কী করবেন? আর এখন একই দিনে একই সময়ে ১৪-১৫টি চাকরির পরীক্ষা হচ্ছে। তাহলে চাররিপ্রার্থীরা যাবেন কোথায়?
করোনার এক বছরে বাংলাদেশে ১৪ হাজার ৪৩৬ জন আত্মহত্যা করেছেন। তাদের অধিকাংশই তরুণ-তরুণী। ১৮ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে তাদের বয়স। আর ১৫ মাসে ১৫১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। যেসব শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন, তাদের মধ্যে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীই আছেন। ১৫১ জনের মধ্যে ৭৩ জন স্কুল শিক্ষার্থী, ২৭ জন কলেজ শিক্ষার্থী,২৯ জন মাদ্রাসার এবং ৪২ জন বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী রয়েছেন।
আর করোনার সময়ে ৮৪.৬ শতাংশ শিক্ষার্থী মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় পড়েছেন। তাদের প্রধানত যেসব সমস্যা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে, মন ভালো না থাকা, ঘুম না হওয়া, হীনমন্যতায় ভোগা, নিজেকে তুচ্ছ মনে করা, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া প্রভৃতি।
তাহলে এখন যেটা করতে হবে, তা হলো, তরুণদের মনে আশা জাগিয়ে তুলতে হবে। আর সেটা কোনো কল্পনার ফানুস নয়। প্রকৃত অর্থেই তারা যাতে ভবিষ্যৎ দেখতে পায় সেরকম কিছু করতে হবে। এটা করতে হবে সরকারকে। করতে হবে কর্পোরেট সেক্টরকে। এই অনেক প্রতারণার সময়ে তরুণদের আত্মবিশ্বাসের জায়গা তৈরি করতে হবে। তাদের উদ্যোক্তা বানাতে হলে প্রতারণার বিদায়ঘণ্টা বাজাতে হবে। তাদের সামনে শততার উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে।
অনেক বেশি এখন পড়ানোর দরকার নেই। শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনাই হলো মূল কাজ। তাদের আনন্দে রাখতে হবে। শুধু যে খেলাধুলা বন্ধুদের সাথে আড্ডাই বিনোদন দেয়, তা নয়। পড়ানোও হতে পারে বিনোদন, যদি শিক্ষক পড়াতে পারেন।
অভিভাবকরা কী করবেন? সন্তানদের ফার্ষ্ট-সেকেন্ডের দৌড় শুরু করে দেবেন? মোটেই তা নয়। সন্তানদের মানুষ বানাতে মনোযোগী হবেন। তাই দরকার গুড প্যারেন্টিং।
এই করোনায় নারীরা সবচেয়ে বেশি অভিঘাতের শিকার হয়েছেন। তাদের প্রতি সহিংসতা বেড়ে গেছে। স্বামী চাকরি হারিয়েছেন- তার দায় পড়েছে স্ত্রীর ওপর। ব্যবসা বন্ধ হয়েছে- তার দায় পড়েছে নারীর ওপর। নারীর মনের খবর কি আমরা রেখেছি? তাদের মনে যে এই করোনায় গভীর ক্ষত তৈরি হয়েছে, তার সমাধান হবে কীভাবে। আমাদের দায়িত্ব নিতে হবে। স্বামীকে দায়িত্ব নিতে হবে। পরিবারের সবাইকে তার মনের যত্ন নিতে সহায়তা করতে হবে। নয়তো আরো বড় ধরনের সংকট তৈরি হবে।
হাসপাতালগুলোতে আমরা শরীরের চিকিৎক বাড়াচ্ছি, কিন্তু মনের চিকিৎসক কোথায়? শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা মনোবিজ্ঞানী কই? বিশ্ববিদ্যালয়ে কাউন্সেলিং-এর কী অবস্থা? আর কর্মক্ষেত্রগুলো কর্মীদের মনের যত্ন নিতে কী ব্যবস্থা রেখেছে?
এবার করোনার অদৃশ্য ক্ষতির হিসাব আমরা করছি না। তাই তো মনের ক্ষতি এখন জীবনের সবচেয়ে বড় ক্ষতি ডেকে আনছে। তাই এখন মনের চিকিৎসায়ই সবচেয়ে জোর দেয়া জরুরি।
হীনমন্যতা, অবসাদ আর আত্মবিশ্বাসের অভাব মনের তিন শত্রু। এই শত্রুদের মনে জায়গা দেয়া যাবে না। তারা যাতে কোনোভাবেই মনে বসবাসের সুযোগ না পায়, তার ব্যবস্থা চাই। জীবনের চেয়ে সুন্দর আর কিছু নাই। আসুন জীবনকে ভালোবাসি। জীবনের জয় গান গাই।