আমার বিয়েরটা ছিল অন্যরকম
২১ সেপ্টেম্বর ২০১৬ভিডিওতে আমি দেখেছি, বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষেও অনেক আনুষ্ঠানিকতা থাকে, দেখেছি কনের প্রতি সবার দৃষ্টিভঙ্গিটা কেমন যেন বদলে যায়৷ নববধূর প্রতি অনেক রকমের প্রত্যাশার চাপও বাড়তে থাকে৷ এ সব বিষয় আতঙ্ক হয়ে যেন আমাকে তাড়া করতো৷
প্রায়ই একটা দুঃস্বপ্ন দেখতাম আমি৷ দেখতাম আমার মা-বাবা এবং অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনেরা জোর করে আমাকে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে৷ সেই দুঃস্বপ্নের সবচেয়ে ভয়ংকর অংশটিতে দেখতাম, আমি আমার কথাগুলো কাউকে বোঝাতে পারছি না, কেউ শুনছে না আমার কথা, আর সেই কষ্টে আমি অঝোরে কেঁদে যাচ্ছি৷ আমি ভাবতাম, পরিবারের কথামতো বিয়ে করতে না চাইলে আমার সঙ্গেও হয়ত আর দশটা মেয়ের সঙ্গে যেমন করা হয়, সেরকম আচরণই করা হবে৷ আমি যেন শুনতাম, আমাকে কাঁদতে দেখেও সবাই হেসে হেসে বলছে, ‘‘বিয়ে হয়ে গেলে এ সব কথা ভেবে ও নিজেও হাসবে৷'' এ রকম স্বপ্ন দেখতে দেখতে প্রায়ই ঘুম ভেঙে যেত, দর দর করে ঘামতাম, ভয়ে আমার শরীর কাঁপতো৷
আমার বিয়েটা হয়ে যাবার পর থেকে, অর্থাৎ এই বছর খানেক ধরে আমার সেই দুঃস্বপ্নটা দেখা বন্ধ৷ এর আগের কয়েকটা বছর আমাকে বহুবার অনুরোধ করে, নানাভাবে আবেগাপ্লুত করে, কোনো ছেলের সঙ্গে দেখা করা বা ফোনে কথা বলানোর চেষ্টা হয়েছে৷ আমাকে বিয়ে দেয়াই ওসবের মূল উদ্দেশ্য৷ কয়েকজনের সঙ্গে দেখা করেছিও আমি৷ কিন্তু মনে হয়, আমার কিছু ধ্যান-ধারণা এবং মতামত তাদের হতাশ করেছে এবং সে কারণে তারা আর আমার সঙ্গে দেখাই করতে চায়নি৷
কিন্তু যখন আমি সঠিক ব্যক্তিটিকে খুঁজে পেলাম, এমন একজনকে যাকে আমি বিশ্বাস করতে পারি, যে আমার চেয়েও পাগল, যার সঙ্গে বাকি জীবন কাটানোর ব্যাপারে আমি একেবারে শঙ্কাহীন, তার সঙ্গে মিলে কেমন করে আমরা জীবনযাপন করবো, সংক্ষেপে তার একটা ছক এঁকে ফেললাম৷
ঢাকার বেশির ভাগ পরিবারের বিয়েতে যেমনটি হয়ে থাকে, আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠানটা একেবারেই সেরকম তিন-চার দিন ধরে চলেনি৷ চাটগাইয়াদের মতো আমরা কয়েক হাজার মানুষকে দাওয়াত দিইনি৷ মাত্র দুশ' মানুষকে দাওয়াত দিয়েছিলাম৷ আমাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং সামাজিক মর্যাদা অনুপাতে সংখ্যাটা সত্যিই বিস্ময়কর রকমের কম৷
আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠান হয়েছে ছোট্ট একটা রেস্তোরাঁয়৷ রেস্তোরাঁর বাইরে অনেকটা জায়গা৷ জায়গাটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর৷ সুন্দর একটা লেক আছে সেখানে৷ লেকের ওপরেই একটা মিনি ব্রিজ৷ ছবি তোলার জন্য জায়গাটা এক কথায় অসাধারণ৷ আমার বন্ধু এবং পরিবারের সদস্যরা খুব আনন্দ করে ছবি তুলেছে সেখানে৷
লেকের পারে পাথর বিছানো৷ সেখানেই আমাদের ‘নিকাহ', অর্থাৎ কাবিননামায় স্বাক্ষর এবং আংটিবদল হয়েছে৷ বন্ধু-স্বজনরা আমাদের জন্য দারুণ একটা অনুষ্ঠান করেছিল৷ কৌতুক, হাসির নাটক, গান এবং জমজমাট নাচ ছিল সেখানে৷ সবার ভবিষ্যৎ বলার জন্য একটা টিয়ে পাখিও রাখা হয়েছিল৷ নিজের ভবিষ্যৎ জানার জন্য সেই টিয়ের সামনে ভিড় করেছিল সবাই৷ পুরান ঢাকার লেবুর শরবত আর লাচ্ছিরও ব্যবস্থা ছিল৷ বিউটি বোর্ডিং থেকে আসা দু'জন বিরতিহীনভাবে অতিথিদের পছন্দের এই পানীয়ের চাহিদা মিটিয়েছে৷
আমি মনে করি, বাংলাদেশের প্রথাগত বিয়ের তুলনায় আমার বিয়েটা অনেকটাই অন্যরকম ছিল৷ কারণ প্রথমত, আমার পার্টনার আর আমি আগেই ঠিক করেছিলাম, বিয়ের অনুষ্ঠানের সবকিছু হবে আমাদের ইচ্ছামতো, আমরাই অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করবো, আমরাই হবো আয়োজক৷ আমরা আমাদের পরিবারের মুরুব্বিদের আগেই বলেছিলাম, স্থান নির্বাচন থেকে শুরু করে খাওয়া-দাওয়া, সাজসজ্জা, অতিথিদের দাওয়াত দেয়া পর্যন্ত সবকিছুর দায়িত্বই যেন তাঁরা আমাদের দু'জনের ওপর ছেড়ে দেন৷
দ্বিতীয়ত, কনেকে বর যে দেনমোহর দেয়, সেটাও আমরা দু'জনই ঠিক করেছি৷ সাধারণত দেনমোহরের জন্য আলাদা একটা দিন, আলাদা আনুষ্ঠানিকতাই থাকে৷ দুই পরিবারের মুরুব্বিরা একসঙ্গে বসেন, তাঁদের মধ্যে আলোচনা হয়, তর্কাতর্কি হয়, তারপর ঠিক হয় বর দেনমোহর হিসেবে কত টাকা দেবে৷ অথচ এটা কিন্তু বর এবং কনেরই আলোচনা করে ঠিক করার কথা৷ এ বিষয়টি নিয়ে মুরুব্বিদের না ভাবার অনুরোধ জানিয়ে আমরাও তা-ই করেছি৷
আমাদের দেশে বিয়ের আসরে কনেরা সাধারণত এক কোণে চুপচাপ বসে থাকে৷ সবাই চায়, কনে গা-ভর্তি গয়না আর চড়া মেকআপ নিয়ে বসে থাকবে আর বন্ধু-বান্ধব বা ভাই-বোনেরা কাছে এলেই হেসে তাদের দিকে তাকাবে৷ শুনে মনে হতে পারে আমি খুব প্রাচীন কালের কথা বলছি, কিন্তু এমনটি আসলে এখনো হরহামেশাই ঘটে৷ এমনিতে এমন সাজে নতুন বৌকে সত্যিই খুব সুন্দর লাগে৷ যারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে পারে, বরকে পাশে নিয়ে ছবি তুলতে পারে, তারা আসলেই খুব ধৈর্যশীল৷ কিন্তু আমি আর আমার পার্টনার ঠিক করেছিলাম, ওভাবে বসে না থেকে বিয়েতে আমরা নিজেরাই মজা করবো৷
বিয়ের অনুষ্ঠানে আমরা মঞ্চ বা নির্দিষ্ট কোনো জায়গায় বসিনি৷ সারাক্ষণ এখান থেকে ওখানে ঘুরে বেড়িয়েছি৷ ঘুরে ঘুরে দেখেছি অতিথিদের কোনো অসুবিধে হচ্ছে কিনা৷ একটা সময় বন্ধুদের সঙ্গে নেচেছিও আমরা৷ কখনো খাবারের কোনো ‘আইটেম' আসতে দেরি হচ্ছে দেখলে রান্নাঘরে গিয়ে তাগিদ দিয়ে এসেছি৷ সব মিলিয়ে আমার বিয়ের অনুষ্ঠানটা ছিল একটা পার্টির মতো, যার মাধ্যমে আমর খুব কাছের মানুষেরা একত্র হয়ে আনন্দ করার সুযোগ পেয়েছে৷
সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও বিয়ের অনুষ্ঠানটা জীবনের অন্যতম বড় ঘটনা৷ বিয়েটা অনেকটা পরিচয় বদলের মাধ্যম৷ অন্য একটি পরিবারের অংশ হওয়া, আপোস, ত্যাগ স্বীকার – এসবও বিয়ের পরিণাম৷ বিশেষ করে কনের বেলায় তো নাকি বিয়ের পর জীবনটাই বদলে যায়, সবাই আশা করে, সব পরিবর্তনকে সে খোলা মনে, দু'হাত বাড়িয়ে বরণ করে নেবে৷
তবে আমরা, মানে আমি আমার আমার পার্টনার মনে করি, পরিবর্তনকে বরণ করা উচিত আবার কখনো কখনো আমাদের একজনেরই তা প্রত্যাখ্যানও করা উচিত৷ কোনো কিছুর সঙ্গে সাবলীল হতে পারাটা খুব জরুরি৷ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, একজন মানুষের অন্যজনের সঙ্গে সাবলীল হওয়া৷ সেই অবস্থাতেই শুধু আপোস বা ত্যাগ স্বীকার স্বতঃস্ফূর্ত হয়, ভালোবাসাও তখন স্থায়ীত্ব পায়৷
এলিটা করিম, বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত সংগীত শিল্পী, সাংবাদিক ও অভিনেত্রী৷
এলিটা করিমের লেখাটি আপনার কেমন লাগলো? জানান নীচের ঘরে৷