আবারও মার্কিন চাপে মাথা নোয়ালো জাতিসংঘ
২৪ এপ্রিল ২০১৯বরাবরই গর্ভপাতের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থানের কথা জানিয়ে আসছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প৷ এবার তাঁর এ অবস্থানের কারণে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে আটকে গেল যুদ্ধের সময় যৌন সহিংসতা বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার একটি পদক্ষেপ৷
১৫ সদস্যের নিরাপত্তা পরিষদে ১৩-০ ভোটে পাস হয়েছে প্রস্তাব৷ চীন এবং রাশিয়া ভোটদানে বিরত ছিল৷
আপত্তিটা কোথায়?
নিরাপত্তা পরিষদে প্রায়ই নানা বিষয়ের প্রস্তাবে সদস্য রাষ্ট্রগুলো আপত্তি জানিয়ে থাকে৷ নিজেদের অবস্থান, আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও কৌশলের কারণে স্থায়ী পাঁচ সদস্যের কারো ভেটোর হুমকি দেয়ার ঘটনাও নতুন নয়৷ কিন্তু যুদ্ধে যৌন সহিংসতা বন্ধের মতো প্রস্তাবে কীভাবে কারো আপত্তি থাকতে পারে, সে বিষয়টিই ভাবাচ্ছে অনেককে৷
তবে আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ মনে হলেও বিষয়টির সাথে আরো অনেককিছুই জড়িত৷
ট্রাম্প ও যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তির মূল জায়গা ছিল প্রস্তাবের তিনটি বিষয়কে ঘিরে৷
- প্রস্তাবের বিভিন্ন স্থানে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বেশ কিছু মামলার উদাহরণ টানা হয়েছে৷ তবে ২০০২ সাল থেকে কার্যকর হওয়া এই আদালতটি স্থাপনে যে আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল, সে রোম স্ট্যাচুট এখনও অনুসমর্থন করেনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র৷ ফলে সে আদালতকে স্বীকৃতিই দেয়নি যুক্তরাষ্ট্র৷
- ২০১৩ সালে যৌন সহিংসতা বন্ধে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে জাতিসংঘ৷ তখন বারাক ওবামার সরকার সেটিতে সম্মতি দিলেও ট্রাম্প প্রশাসন কিছুদিন আগেই জানিয়ে দিয়েছে, এই প্রস্তাবের ভাষা তাঁদের পছন্দ নয়৷ একই কারণে জার্মানির উত্থাপন করা নতুন প্রস্তাবটিরও বিরোধীতা করেছে দেশটি৷
নির্বাচনি প্রচারণার শুরু থেকেই গর্ভপাতের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান জানিয়ে এসেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প৷ নির্বাচিত হওয়ার পর গর্ভপাত বন্ধে নানারকম পদক্ষেপ নিয়েছেন তিনি৷ যেসব ক্লিনিক গর্ভপাতে উৎসাহিত করে, সেগুলোতে বরাদ্দ বন্ধ করে দেয়ার হুমকিও দিয়েছেন তিনি৷ এমনকি তাঁর এমন অবস্থানের বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়ার ঘোষণাও দিয়েছে বেশ কয়েকটি রাজ্য সরকার৷
দেশে, এমনকি নিজের দলের মধ্যেও এ বিষয়ে যথেষ্ট বিরোধীতার মুখোমুখি হলেও অনড় ট্রাম্প৷ ফলে জাতিসংঘে এমন কোনো প্রস্তাবে সম্মতি জানাতে চাননি তিনি, যা তাঁর ব্যক্তিগত অবস্থানের বিপক্ষে যায়৷
জার্মানির মূল প্রস্তাবে এক জায়গায় যৌন সহিংসতার শিকার ব্যক্তিদের যৌন স্বাস্থ্য রক্ষায় দেশগুলোর সচেষ্ট হওয়া এবং প্রজননে নারীর অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে৷ ঠিক এ জায়গাতেই আপত্তি যুক্তরাষ্ট্রের৷ দেশটি মনে করে, ‘প্রজননের অধিকার' বা ‘সন্তান জন্মদানের অধিকার' বলার মাধ্যমে আসলে গর্ভপাতকে সমর্থন করছে এ প্রস্তাব৷
- অপর যে বিষয়টিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়া ও চীনও আপত্তি জানিয়েছে, তা হলো জাতিসংঘের মনিটরিং বডিকে যৌন সহিংসতা পর্যবেক্ষণ ও প্রতিবেদন দিয়ে ব্যবস্থা নেয়ার প্রস্তাব৷ দেশগুলো বলছে, আলাদা করে এমন কোনো বডি বা কমিটির কোনো প্রয়োজন দেখছে না তাঁরা৷
তীব্র প্রতিক্রিয়া
শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের হুমকিতে উপরের সবকিছুই বাদ দেয়া হয়েছে প্রস্তাব থেকে৷ যুক্তরাষ্ট্রও তা মেনে নিয়ে পক্ষে ভোট দিয়েছে৷ কিন্তু অনেক সদস্য রাষ্ট্র এবং অধিকার কর্মী বলছেন, এর ফলে দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধে নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে যাঁরা কাজ করে আসছেন, তাঁদের নৈতিক পরাজয় ঘটলো৷
জার্মানির প্রস্তাবে শুরু থেকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়ে আসা ফ্রান্স যৌন স্বাস্থ্যরক্ষার নিশ্চয়তা ছাড়াই প্রস্তাব পাস হওয়াকে ‘লজ্জাজনক' বলে আখ্যা দিয়েছে৷ জাতিসংঘে ফরাসি দূত ফ্রাসোঁয়া দেলাত্রে বলেছেন, এ সিদ্ধান্ত ‘নারীর মর্যাদা নষ্ট করলো'৷
তিনি বলেন, ‘‘যেসব নারী যুদ্ধে যৌন সহিংসতার শিকার হয়ে গর্ভধারণে বাধ্য হয়েছেন, তাঁদের গর্ভপাতের অধিকার দিতে ব্যর্থ হলো নিরাপত্তা পরিষদ৷ এটা ধারণারও অতীত, এবং কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না৷''
মানবাধিকার সংস্থাগুলো যুক্তরাষ্ট্রের এমন অবস্থানে হতাশা প্রকাশ করেছে৷ যুদ্ধে লিপ্ত দেশগুলোর কাছে এ অবস্থান ‘ভুল বার্তা' পৌঁছে দেবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছে সংস্থাগুলো৷
এডিকে/ডিজি (এপি, এফপি, রয়টার্স)