1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

আন্দোলনের তলায় অন্ধকার তো থাকবেই!

৬ জানুয়ারি ২০২৩

মি টু আন্দোলন অত্যন্ত জরুরি একটি ঘটনা৷ কিন্তু তা ব্যবহার করছেন, এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়৷

https://p.dw.com/p/4LpP8
সমাজমাধ্যমে এমন অনেকের নামে এমন অনেক কথা লেখা হয়েছে, ব্যক্তিগতভাবে জানি, যা সম্পূর্ণ ঠিক নয়৷
সমাজমাধ্যমে এমন অনেকের নামে এমন অনেক কথা লেখা হয়েছে, ব্যক্তিগতভাবে জানি, যা সম্পূর্ণ ঠিক নয়৷ ছবি: imago images/Pacific Press Agency

ভারতীয় ফৌজদারি আইনে ৪৯৮(এ) ধারাটি নিয়ে একসময় বিপুল বিতর্ক শুরু হয়েছিল৷ গার্হস্থ্য হিংসার জন্য ওই ধারা ব্যবহার করা যেত৷ যে কোনো বিবাহিত নারী ওই ধারায় পুলিশের কাছে অভিযোগ জানালে পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে স্বামী এবং তার পরিবারকে গ্রেপ্তার করতে পারতো৷

ধারাটি গুরুত্বপূর্ণ, সন্দেহ নেই। ভারতে গার্হস্থ্য হিংসার শিকার নারীর সংখ্যা ভয়াবহরকমের বেশি৷ প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এর শিকার হন৷ ফলে তা বন্ধ করতে কড়া আইনের অবশ্যই প্রয়োজন৷ কিন্তু এর উল্টো দিকের চিত্রটিও খুব পরিষ্কার নয়। নারীবাদীদের একাংশও মনে করেন, বহু নারী এই আইনের সুয়োগ নিয়েছেন৷ অপ্রয়োজনে এই আইনের সুযোগ নিয়ে স্বামী এবং তার পরিবারকে অন্তত কিছুদিনের জন্য জেলে পাঠিয়েছেন৷ পরে দেখা গেছে, অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই। একবার নয়, বার বার ঘটেছে এই ঘটনা৷

ভারতের মি টু আন্দোলন নিয়েও সেই একই কথা বলতে হয়৷ ২০১৭-১৮ সালে যখন মি টু আন্দোলন শুরু হয়েছিল গোটা বিশ্বে এবং ভারতে, একের পর এক ভয়াবহতার কথা গোচরে এসেছিল৷ সমাজমাধ্যমকে ব্যবহার করে নারীরা জানাচ্ছিলেন, কত কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তাদের৷ সমাজের ভয়ে, কাজ হারানোর ভয়ে এতদিন যা তারা বলে উঠতে পারেননি৷ সমাজের বহু বিশিষ্ট, প্রতিষ্ঠিত, তথাকথিত 'বুদ্ধিজীবী', 'বিদ্বজ্জনে'র মুখোশের আড়ালে থাকা আসল পরিচয় স্পষ্ট হয়েছিল৷ পাল্টা প্রতিবাদ না করে অনেকেই তখন মুখ লুকনোর জায়গা খুঁজছিলেন৷

কিন্তু প্রায় সেই সময় থেকেই একটা পাল্টা স্বরও ক্রমশ জোরালো হচ্ছিল৷ যা বলা হচ্ছে, তাতে অতিকথন নেই তো? সমাজের আবেগের ঝোল নিজের দিকে টানতে কোথাও অতিরঞ্জন হয়ে যাচ্ছে না তো? বিতর্কিত প্রশ্ন, সন্দেহ নেই৷ ব্যক্তিগত অনুভূতির জায়গা থেকে বলতে পারি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে যা লেখা হয়েছে, বাস্তব ঘটনা তার চেয়েও ভয়ংকর ছিল৷ মি টু আন্দোলন বহু নারীকে মুখ খোলার সাহস জুগিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সমাজের সামনে সমস্ত কথা বলে ফেলার জোর এখনো তাদের নেই৷ এই সমাজ ঐতিহাসিকভাবে নারীর উপর যে অত্যাচার চালিয়ে গেছে, এত দ্রুত, একটা দুটো আন্দোলনে তার পুরোটা প্রকাশ পাওয়া অসম্ভব৷

এমন অনেক বন্ধুকে চিনি, মি টু-র ড্রাফট তৈরি করেও শেষ পর্যন্ত তা প্রকাশ করতে পারেনি৷ ভয় পেয়েছে৷ সমাজ, কর্মক্ষেত্র, পরিবারকে ভয় পেয়েছে৷ এমন অনেক বন্ধুকে চিনি, মি টু-র স্রোতে ভেসে কিছু কথা লিখে ফেললেও, বাস্তবের অর্ধেকটা বলতে পেরেছে মাত্র৷

তবে এমন বন্ধুও আছে কাছেই, যারা মি টু-র শিকার হয়েছে৷ আলো থাকলে অন্ধকার থাকেই৷ আন্দোলনের ঝড় উঠলে বেনো জল ঢুকবেই৷ সমাজমাধ্যমে এমন অনেকের নামে এমন অনেক কথা লেখা হয়েছে, ব্যক্তিগতভাবে জানি, যা সম্পূর্ণ ঠিক নয়৷ ভালোবাসার অভিব্যক্তি জানানোর মধ্যে কোনো অপরাধ নেই৷ অপরাধ তখনই হয়, যখন অন্যের অভিব্যক্তিকে সম্মান না করে কোনো হীন আচরণ করা হয়৷ মুশকিল হলো, ইদানীং সমাজমাধ্যমে এমন অনেক স্ক্রিনশট শেয়ার করা হয়, যা হীন নয়৷ একটি মানুষের, একটি মুহূর্তের অভিব্যক্তিমাত্র৷

স্যমন্তক ঘোষ, ডয়চে ভেলে
স্যমন্তক ঘোষ, ডয়চে ভেলেছবি: privat

সমাজ আসলে এখন 'ট্রোল' নামক এক আশ্চর্য শব্দে বিভক্ত হয়ে গেছে৷ একদল ট্রোল করে, একদল ট্রোলের শিকার হয়। এই ট্রোলের কোনো যুক্তি থাকে না৷ দুইটি পক্ষ থাকে কেবল৷ যার পাল্লা যত ভারী, সমাজ মাধ্যমে সে তত প্রতিষ্ঠিত৷ এই অদ্ভুত খেলায় নীতির কোনো বালাই নেই৷ প্রকাশ্য আর ব্যক্তিগতের কোনো ভেদ নেই৷ দুইদিন আগেও ব্যক্তিগত স্মৃতি হিসেবে যা সংগ্রহ করা হয়েছিল, আচমকাই তা প্রকাশ্য ট্রোলের হাতিয়ার হয়ে উঠল। বার বার ঘটছে এমন ঘটনা৷ বাইনারিতে কাউকে সাদা কাউকে কালোয় ভেঙে ফেলছে সমাজ৷ বিচারের, তলিয়ে দেখার ইচ্ছা এবং অবকাশ খতম হয়ে যাচ্ছে। এইটে চিন্তার৷

সামাজিক মাধ্যম এমনই এক মাধ্যম যা এভাবে ব্যবহৃত হবেই৷ ইদানীং কেউ কেউ তা বুঝতে পারছেন৷ ফলে ট্রোলাক্রান্তের পাশেও দাঁড়াচ্ছে মানুষ৷ সমাজমাধ্যমে দাঁড়াচ্ছে, ব্যক্তিগত পরিসরেও৷ এমনই এক বন্ধু সম্প্রতি ট্রোলের শিকার হয়ে আত্মহত্যার কথা ভেবেছিল৷ তাকে বুঝিয়ে, সঙ্গে থেকে মূলস্রোতে ফিরিয়ে এনেছেন যারা, তারাও কলকাতার বিশিষ্ট মানুষ৷ যে ট্রোল করেছিল, তার সঙ্গে বারংবার কথা বলে একটা ব্রিজ তৈরির চেষ্টা করেছেন তারা৷ পুরোটা হয়তো সম্ভব হয়নি৷ কিন্তু চেষ্টা তো হলো? এ-ও তো কম নয়!

৪৯৮(এ) যেমন ভুল নয়, মি টু-ও ভুল নয়৷ সমাজের গভীর ক্ষত থেকেই এক ধারা এবং এক আন্দোলনের জন্ম। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে না গেলে মানুষ পথে নামেন না৷ নিজের জীবনের অন্ধকার কাহিনি সমাজের সামনে তুলে ধরেন না৷ ঘর ভাঙবে জেনেও স্বামীর নামে অভিযোগ দায়ের করেন না৷ যারা এর সুযোগ নেন, তাদের প্রথম ধাপেই চিনে ফেলা দরকার৷ কাজটা কঠিন৷ কাজটা বিশ্বাসের৷ বিশ্বাসটুকু ধরে রাখতে পারলে, সমাজ অনেকটা সহজ হয়ে যায়৷ 

২০১৮ সালের ছবিঘর