অসহিষ্ণুতাই যত নষ্টের মূল
৮ এপ্রিল ২০২২দুই বন্ধুর কথা খুব মনে পড়ছে৷ দুইজনেই কলেজের৷ একজনের নাম পূজা অন্যজন আফরোজা খাতুন৷ গোঁড়া হিন্দু পরিবারের মেয়ে পূজা আসলামকে বিয়ে করে এখন দুবাই নিবাসী৷ ধর্ম পরিবর্তন হয়েছে৷ বদলেছে নামও৷ ছেলের নাম আমন৷ নাসিমা খিদিরপুরে থাকে এখনো৷ বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ওর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, ততদিনে বিয়ে হয়ে এক সন্তানের মা৷
সম্প্রতি ফেসবুকে পূজা বোরখা পরা ছবি পোস্ট করেছে৷ পুরনো বন্ধুর প্রশ্নের উত্তরে একলাইনের উত্তর-- ‘কেউ চাপিয়ে দেয়নি, নিজের ইচ্ছায় পরেছি৷ ঠিক যেমন মা শাঁখা-সিঁদুর পরতেন৷' বটেই তো! শাঁখা-সিঁদুর, লোহা-পলা পরার জন্য হিন্দু নারীকে গোঁড়া হতে হয় না৷ বছরের পর বছর ধরে এ রেওয়াজ চলে আসছে৷ বহু নারী সেই রেওয়াজ ভেঙেছেন৷ প্রতিবাদও করেছেন৷ আবার মনেপ্রাণে প্রগতিশীল হয়েও অনেকে পরিবারের কথা ভেবে রেওয়াজ মেনে নিয়েছেন৷ পূজার সঙ্গে আড্ডায় সেই কথাগুলিই বার বার উঠে আসছিল৷ পূজা বলছিল, দুবাইয়ে কোনো কোনো অনুষ্ঠানে ডিজাইনার বোরখা পরে যেতে ওর ভালো লাগে৷
আফরোজার সঙ্গে প্রথম আলাপ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিনে৷ জিন্স-টপ পরিহিতা আফরোজা ক্যান্টিনের বেঞ্চে উঠে ডাফলি বাজিয়ে স্লোগান দিচ্ছিলেন৷ আপাদমস্তক বামপন্থি আফরোজার সঙ্গে প্রথম আলাপেই বন্ধুত্ব৷ এহেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নেত্রীর সঙ্গে একদিন তার বাড়ি যাওয়া সাব্যস্ত হলো৷ খিদিরপুরের কার্ল মার্কস সরণিতে বাস পৌঁছানোর পর আফরোজা বলল, পরের স্টপেই নামতে হবে৷ যদিও আমরা জানি, তার বাড়ি তখনো বেশ কয়েক স্টপ দূরে৷ বাস থেকে নেমে আমাদের দাঁড় করিয়ে, পাঁচ মিনিটের জন্য উধাও হলো আফরোজা৷ ফিরে এলো এক অন্য মানুষ৷ মাথা থেকে পা পর্যন্ত বোরখায় ঢাকা৷ বিপ্লবের স্বপ্ন দেখা আফরোজা পরিবারের নির্দেশ তখনো ভাঙতে পারেননি৷
শ্বশুরবাড়ির রীতি-রেওয়াজ না মানলে অত্যাচারের কাহিনি শুনিয়েছিল বাকি রাস্তায়৷হাড় হিম করা সেই গল্প৷ বরের থেকে তালাক নিয়ে আফরোজা এখন সিঙ্গল মাদার৷ কলেজের অধ্যাপিকা এখনো সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখেন৷ ব্যক্তি স্বাধীনতার পক্ষে সওয়াল করতে গিয়ে মৌলবাদীদের হুমকির মুখেও পড়তে হয়েছে তাকে৷
দক্ষিণ ভারতে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া হিজাব-কাণ্ড নিয়ে আফরোজার মতামত ভিন্নধর্মী৷ সে মনে করে, ইউনিফর্মে ধর্মের রং থাকা অনুচিত৷ যে কোনো ধর্মীয় পোশাক অথবা চিহ্ন যদি ব্যক্তি স্বাধীনতার পরিপন্থি হয়, তাহলে বর্জনের পক্ষে আফরোজা৷ পূজা নয়৷
হিজাব-কাণ্ডে পূজার বক্তব্য, ধর্মীয় পোশাক পরে কলেজে যাওয়া ব্যক্তি স্বাধীনতা৷ রাষ্ট্র বা সমাজ সেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারে না৷
ব্যক্তি স্বাধীনতার ধারণা একেকজনের কাছে একেকরকম৷ বিভিন্ন সমাজ এবং রাষ্ট্রের কাছেও ভিন্ন৷ সকলেই নিজের নিজের মতো করে তার সংজ্ঞা তৈরি করে৷ কালে কালে এমনটাই হয়ে এসেছে এবং ভবিষ্যতেও নিশ্চয় তা-ই হবে৷ সমস্যা অসহিষ্ণুতায়৷ দুঃখজনক সত্যি হলো সেইটেই এখন বাস্তব৷
গত কয়েকবছরে একের পর এক অসহিষ্ণুতার ঘটনা ঘটেছে এবং ঘটেই চলেছে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের এই ভারতবর্ষে৷ পোশাক নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে, খাবার নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে, ভাষা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে, সাজসজ্জা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে৷ কেউ কারও কথা শুনতে নারাজ৷ সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজ, সমাজ পরিচালিত রাজনীতি গোত্তা খাওয়া ঘুড়ির মতো একমুখী আচরণ করছে৷ আর সেজন্যই প্রতিদিন নতুন নতুন বিতর্ক মুখ তুলছে-- কখনো হিজাবে, কখনো দাড়িতে, কখনো বা গেরুয়া কাপড়ে৷
সমাজের আসলে একগুচ্ছ পূজা আর আফরোজা প্রয়োজন৷ ব্যক্তিগত পরিসরে তাদের অভিমত ভিন্ন, কিন্তু সমষ্টির পরিসরে তারা একে অপরকে স্পেস দিতে প্রস্তুত৷লড়াই নয়, অসহিষ্ণুতা নয়, বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যই তাদের ধর্ম৷ ভারতের ধর্মও তা-ই ছিল৷ আগামী দিনে ফের তা প্রতিষ্ঠা পাবে নিশ্চয়ই৷