বছর চারেক আগের ঘটনা। ভারতের জনপ্রিয় টিভি শো 'কফি উইথ করণ'-এ এসে হার্দিক পান্ডিয়া ও কে এল রাহুল এমন সব মন্তব্য করেছিলেন, যার ফলে ভারতে বিতর্কের সুনামি উঠেছিল। তারা মেয়েদের নিয়ে, নিজেদের যৌন জীবন নিয়ে সোজাসাপটা নানা কথা বলেছিলেন। মেয়েদের নিয়ে মন্তব্য তো রীতিমতো মর্যাদাহানিকর।
আসলে ভারতে ক্রিকেট খেলে যদি জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়া যায়, তাহলে খুব কম বয়সে বিপুল অর্থ ও তার থেকেও বেশি খ্যাতি পাওয়া যায়। আর আজকাল ক্রিকেটের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে গেছে বলিউড, জড়িয়ে গেছে মডেলিংয়ের দুনিয়া। এই দুনিয়ার সঙ্গে বাস্তবের সম্পর্ক নেই বললেই চলে। তারা থাকে নিজের জগতে। যে দুনিয়ার রীতিনীতি, নিয়ম-কানুন আলাদা। আর ক্রিকেটাররা যখন সুযোগ পায়, তখন তাদের বয়স ২২-২৩-এর মতো। ফলে মাথা ঘুরে যাওয়া স্বাভাবিক। সেখানে মাথা ঠিক রেখে বিতর্ক এড়িয়ে কেমনভাবে থাকতে হয়, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলেন শচিন রমেশ টেন্ডুলকর এবং রাহুল দ্রাবিড়।
তারা কখনো এমন কিছু করেননি যাতে তাদের ভাবমূর্তি খারাপ হতে পারে। শচিন অনেকবার বলেছেন, তার দিকে তাকিয়ে থাকে ভারতের যুবসমাজ। তাই তাকেও সেইভাবে চলতে হয়।
কিন্তু সকলে তো সচিন বা রাহুল নন, তাই তারা হামেশা বিতর্ক ডেকে আনেন। যেমন এনেছিলেন হার্দিক ও কে এল রাহুল। করনের শো-তে হার্দিক মেয়েদের সম্পর্কে বলেছিলেন, ''আই হ্যাভ টু সি হাউ দে(গার্লস) মুভ ফার্স্ট। আই হ্যাভ টু ইমাজিন দ্য পিকচার।''
কে এল রাহুল বলেছিলেন, তার যখন ১৮ বছর বয়স, তখন তার মা কনডম পান। তারপর বকুনি। মা চলে যাওয়ার পর বাবা এসে বলেছিলেন, তুমি যে ওটা ব্যবহার করছ, তা দেখে আমি খুশি। নিজেকে নিরাপদ রাখাটা জরুরি।
আর হার্দিক বলেছিলেন, তিনি যেদিন কৌমার্য হারিয়েছিলেন, সেদিন বাড়িতে ঘোষণা করেছিলেন, 'আজ করকে আয়া।'
হার্দিক ও রাহুলের কথা আর দীর্ঘ করব না। এরপর বিসিসিআই জানায় কমিটি অফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের সুপারিশ মেনে দুজনকে সাসপেন্ড করা হচ্ছে। বিদেশ সফর থেকে তাদের ফেরত আনা হয়। সেসময়ের অধিনায়ক বিরাট কোহলি জানান, দল তাদের মন্তব্যের সঙ্গে একমত নয়।
এখন অবশ্য সেসব অতীত। হার্দিক এখন টি২০-তে অধিনায়কত্ব করছেন। কে এল রাহুলও সহ-অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন।
ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেট। জনপ্রিয় বললে ভুল হবে। ক্রিকেট মানে এখন উন্মাদনা। বিশেষ করে আইপিএল আসার পর থেকে তো একদিকে টাকা, অন্যদিকে চায়-ছয় ও গ্ল্যামারের বন্য়া বইছে। তবে আইপিএল আসার আগেও ক্রিকেটারদের নিয়ে উন্মাদনা কম হয়নি। একটা সময় ভিভ রিচার্ডসের সঙ্গে নীনা গুপ্তার সম্পর্ক বা সোবার্সের সঙ্গে অ়ঞ্জু মহেন্দ্রর প্রেম নিয়ে কম লেখালিখি হয়নি।
এমনকী সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে নাগমার সম্পর্ক নিয়েও তো কম গুঞ্জন ওঠেনি। অনেক পরে নাগমা একবার মুখ খুলেছিলেন। ২০২০ সালে তিনি যখন সামাজিক মাধ্যমে সৌরভকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানান, তখনও আলোড়ন কম হয়নি। সৌরভ অবশ্য আগাগোড়া নীরব থেকেছেন। কিছুদিন আগে সৌরভের সঙ্গে বিরাট কোহলির ঝগড়া তো অসম্ভব খারাপ মোড় নিয়েছিল। তখন বোর্ড প্রেসিডেন্ট সৌরভকে কার্যত মিথ্যাবাদী বলেছিলেন বিরাট। বিরাটের সঙ্গে গৌতম গম্ভীরের ঝগড়াও তো টিভির কল্যাণে সকলে দেখে ফেলেছেন।
তেমনই কম হইচই হয়নি ক্রিকেটারদের ম্যাচ ফিক্সিং দুর্নীতিতে ডুবে থাকার অভিযোগ নিয়ে। দ্রুতগতির বোলার শ্রীসন্থকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। জেলে যেতে হয়েছিল। অজয় জাদেজার ক্ষেত্রে পাঁচ বছরের নির্বাসনের নির্দেশ দেয়া হয়। ভারতের সাবেক অধিনায়ক ও শিল্পী ক্রিকেটার আজহারউদ্দিনের নামও বেটিং কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িয়েছিল। তবে আদালত পরে জানায়, তার বিরুদ্ধে কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ নেই। ক্রিকেটাররা যদি কিছু পয়সার লোভে ম্যাচ ফিক্সিংয়ে জড়ান, তাহলে আর কী বাকি থাকে!
একেবারে হালের ঘটনায় আসা যাক। মহম্মদ শামির সঙ্গে তার স্ত্রী হাসিন জাহানের সম্পর্ক। হাসিন জাহান অভিযোগ করেন, শামি তাকে নির্যাতন করেছেন, শামি অন্য মেয়েদের প্রতি আসক্ত ইত্য়াদি। এই অভিযোগের পর শামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল। মামলা এখনো আদালতে চলছে। ২০১৪ সালে শামির সঙ্গে হাসিনের বিয়ে। চার বছর পরেই হাসিন অভিযোগ করা শুরু করেন। হাসিন ফেসবুকে শামির বিয়ে-বহির্ভূত সম্পর্ক নিয়ে পোস্ট করেছেন। বিস্ফোরক কথা বলেছেন। যেহেতু বিষয়টা বিচারাধীন, তাই ফয়সালা না হলে কিছু বলা যাচ্ছে না।
ক্রিকেটাররা যদি ক্রিকেটের বাইরের বিষয়ে বেশি নজর দেন, অসম্ভব প্রতিভাসম্পন্ন হয়েও যদি অনুশীলনে ফাঁকি দেন, তাহলে কী হয়, তার উদাবহরণ হিসাবে আমাদের সামনে আছেন বিনোদ কাম্বলি। শচিনের একদা ঘনিষ্ঠ বন্ধু, যাকে একসময় তার মতোই প্রতিভাধর মনে করা হত, সেই কাম্বলি তো ক্রিকেট দুনিয়া থেকেই হারিয়ে গেলেন।
আসলে যেখানে এত বিপুল অর্থের হাতছানি, যেখানে ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িয়ে যায় বলিউড, যেখানে ক্রিকেটারদের দেখলেই অন্ধের মতো ছুটে যায় মানুষ, সেখানে এই খ্যাতি, যশ, অর্থের মধ্যে মাথা ঠিক রাখাও কঠিন। ফলে প্রতিনিয়ত একটা পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় তাদের। সীমার মধ্যে থাকার পরীক্ষা। কেউ তা পারেন, কেউ পারেন না। না পারলেই তখন বিতর্ক তাড়া করে তাদের। কারণ, এটা এমন দুনিয়া, যেখানে হিরো থেকে জিরো হতে বেশি সময় লাগে না।