‘আমি অপরাধীদের বিচার চাই’
২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির উল্টো দিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেটের উত্তর পাশে দুর্বৃত্তরা হত্যা করে বিজ্ঞান লেখক এবং ব্লগার অভিজিৎ রায়কে৷ দুর্বৃত্তদের হামলায় তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাও গুরুতর আহত হন৷ পরে সুস্থ হয়ে তিনি দেশের বাইরে চলে যান৷ ওই ঘটনায় তখন অভিজিতের বাবা অধ্যাপক ড. অজয় রায় শাহবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন৷ বিন্তু তিন বছরেও পুলিশ এই মামলায় চার্জশিট দিতে পারেনি৷ এমনকি আদালতে কোনো তদন্ত প্রতিবেদনও দাখিল করেনি তারা৷ গত ১৩ ফেব্রুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের দিন ধার্য ছিল৷ কিন্তু কোনো প্রতিবেদন দাখিল না করায় ঢাকা মহানগর হাকিম আহসান হাবিব প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ১৫ মার্চ নতুন দিন ধার্য করেছেন৷
মামলাটি এখন তদন্ত করছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট৷ রবিবার কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের কাছে অবশ্য দাবি করেছেন, ‘‘অভিজিৎ হত্যায় জড়িত তিন জনকে আমরা গ্রেপ্তার করেছি৷ তারা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে৷ আমাদের তদন্ত ও তাদের জবানবন্দির ভিত্তিতে আমরা জানতে পেরেছি, অভিজিৎ হত্যার সময় ঘটনাস্থলে নব্য জেএমবি'র পলাতক নেতা মেজর জিয়া (সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত) উপস্থিত ছিল৷ দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে মোট ৯ জন এই হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়৷’’
তিনি বলেন, ‘‘হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত জিয়াসহ ৫ জন এখনও পলাতক আছে৷ তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে৷ তবে তাদের ধরতে না পারলেও আমরা খুব শিগগিরই চার্জশিট জমা দেবো৷’’
অভিজিৎ হত্যার পর র্যাব আরো সাত জনকে গ্রেফতার করেছিল৷ মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘‘অভিজিৎ হত্যায় র্যাবের গ্রেপ্তার করা সাত জনের কোনো সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি৷’’
অভিজিতের বাবা অধ্যাপক অজয় রায়ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘দু'সপ্তাহ আগে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের তদন্ত কর্মকর্তা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন৷ তিনি জানান, তারা যে তিনজনকে ধরেছেন তারা স্বীকারোক্তি দিয়েছে৷ আর একজন মুকুল রানা মারা গেছে৷ তারা এখন মেজর জিয়াকে ধরার চেষ্টা করছে৷ তাকে ধরতে পারলেই চার্জশিট দেবে৷ তারা মামলাটি নাকি ডিটেক্ট করে ফেলেছে৷ আরো পাঁচ জন হত্যায় জড়িত৷ মেজর জিয়াই এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারী৷’’
তিনি বলেন, ‘‘আমাকে দু'দিন আগেও আবার তদন্তকারী টেলিফোন করে জানিয়েছে, তারা চাইলে এখনই চার্জশিট দিতে পারে৷ কিন্তু মেজর জিয়াকে ধরে চার্জশিট দিতে চায়৷ এজন্য তিন-চার মাস সময় চেয়েছে৷ এর মধ্যে না পারলে চার্জশিট দিয়ে দেবে৷’’
এখন পর্যন্ত মামলার তদন্তে সন্তুষ্ট কিনা জানতে চাইলে অজয় রায় বলেন, ‘‘আমি হোপফুল বা অতশত বুঝি না৷ আমি শান্ত হবো তখন, যখন দেখবো অপরাধীরা ধরা পড়েছে, তাদের বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে, তাদের বিচার হয়েছে৷ শুধু চার্জশিট দিলেই তো হবে না৷ আদালতে তো অপরাধ প্রমাণ করতে হবে৷ তাতে কতদিন লাগে কে জানে৷’’
ব্লগার হত্যার বিচার হয় না:
২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত সাত জন লেখক, প্রকাশক এবং ব্লগার হত্যার ঘটনা ঘটেছে৷ আর হত্যাসহ হামলার ঘটনা ঘটেছে ১০টি৷
২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ব্লগার রাজীব হায়দারকে হত্যা করা হয়৷ সেই মামলার রায় দিয়েছে আদালত৷ এর আগে ১৩ জানুয়ারি ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিনের ওপর হামলা হয়৷ ওই মামলার চার্জশিট দেয়া হয়েছে৷ আসিফ এখন দেশের বাইরে আছেন৷
অভিজিৎ রায় ছাড়াও ২০১৫ সালে ঢাকা ও সিলেটে খুন হন তিন জন ব্লগার৷ তাঁরা হলেন, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ওয়াশিকুর রহমান বাবু, মুক্তমনা ব্লগের আরেক ব্লগার, লেখক ও ব্যাংক কর্মকর্তা অনন্ত বিজয় দাস, ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় (নিলয় নীল)৷
এছাড়া একই বছরের অক্টোবরে ঢাকায় অভিজিৎ রায়ের বইয়ের দুই প্রকাশনা সংস্থার কার্যালয়ে হামলা হয়৷ হত্যা করা হয় জাগৃতি প্রকাশনীর ফয়সল আরেফিন দীপনকে৷ শুদ্ধস্বরের কর্ণধার আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুলসহ তিনজনকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করা হয়৷
২০১৬ সালের এপ্রিলে ঢাকায় হত্যা করা হয় সমকামী অধিকারকর্মী জুলহাজ মান্নান ও তাঁর বন্ধু মাহবুব রাব্বি তনয়কে৷ মানবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘তিন বছর আগে অভিজিৎ হতার পর র্যাব সাত জনকে আটক করেছিল৷ তখন তারা বলেছিল, এরাই অভিজিৎ হত্যার সঙ্গে জড়িত এবং তারা হত্যাকাণ্ডের সব কিছু জানতে পেরেছে৷ আড়াই মাস আগে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট তদন্তর দায়িত্ব নেয়৷ এখন তারা বলছে র্যাব যাদের গ্রেপ্তার করেছে অভিজিৎ হত্যায়, তাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাচ্ছে না৷ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে এক ধরনের অনৈতিক প্রতিযোগিতা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে৷ সন্দেহের সৃষ্টি হচ্ছে যে, যাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, তারা আসলেই হত্যাকাণ্ডে জড়িত কিনা৷ প্রকৃত তদন্ত আসলে কী হচ্ছে, তা নিয়ে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না৷’’
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘ব্লগার হত্যা মামলার প্রায় সবগুলোরই একই অবস্থা৷ তদন্ত নিয়ে তেমন কোনো অগ্রগতির খবর আমরা পাই না, যা পাই তা সন্দেহ আর সংশয় আরো বাড়িয়ে দেয়৷ এমনকি হোলি আর্টিজানের ঘটনায়ও চার্জশিট দেয়া হচ্ছে বলে শুনছি অনেক দিন ধরে৷ কিন্তু বাস্তবে তা এখনো হয়নি৷ ফলে বিচারহীনতার সংস্কৃতি আরো জেঁকে বসছে৷’’
গত বছরের জুন মাসের এই ছবিঘরটি দেখুন...